ঢাকা, রবিবার   ১৯ মে ২০২৪

ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলা

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্নের অপপ্রয়াস

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৪:০৮, ৪ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৪:৩৬, ৪ মার্চ ২০১৮

দেশ বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় সারাদেশে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও চলছে তীব্র প্রতিবাদ। সর্বস্তরের মানুষ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করছেন। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও। মুক্তিযুদ্ধের অাদর্শের পক্ষে কাজ করে তেমন কয়েকজনের সঙ্গে একুশে টেলিভিশন অনলাইনের পক্ষে যোগাযোগ করা হয়। তারা সবাই ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারীদের অনতিবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। পাশাপাশি তারা দাবি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্নের অপপ্রয়াসে এ হামলা করা হয়েছে। এ হামলা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয় বরং ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে মুক্তমনা লেখকদের ওপর যেসব হামলা হয়েছে, এটা তার ধারাবাহিকতা মাত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক অাবুল কাসেম ফজলুল হক। ধর্মান্ধ মৌলবাদি গোষ্ঠীর অাক্রমনে তিনি তার সন্তান ফয়সাল অারেফীন দীপনকে হারিয়েছেন। সেই কাটা ঘা এখনো শুকায়নি। একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সঙ্গে অালাপকালে এই প্রবীণ অধ্যাপক বলেন, ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। গত কয়েক বছর ধরে এধরণের ঘটনার প্রবণতা বাড়ছে।

অধ্যাপক অাবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, মানুষের সমাজে খুনাখুনি চিরকাল ছিল। তার কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, সেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, অাদর্শগত, সাংস্কৃতিকসহ নানা ধরণের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান।

এই প্রবীণ চিন্তাবিদ বলেন, অামরা শতশত বছর ধরে র‌্যাব, ক্রসফায়ার, সোয়াটসহ এসব শব্দের সঙ্গে অপরিচিত ছিলাম। কিন্তু গত বিশ বছর ধরে এর প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। কারণ, অামাদের রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকের অভাব বাড়ছে। সবাই সবার জায়গায় কাজ করছে ঠিক, কিন্তু তাতে অশুভবুদ্ধি সম্পন্ন লোকের প্রাধান্য বাড়ছে।

অধ্যাপক অাবুল কাসেম ফজলুল হক এ সময় বলেন, সংস্কৃতি শুধু রবীন্দ্র সংগীত চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। পরিধি ব্যাপক। ঠিক তেমনি শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। অামাদের চর্চার জায়গাটা উন্মুক্ত করতে হবে। মূলত এখানেই অামাদের সঙ্গে মৌলবাদীদের সংঘর্ষ।

অধ্যাপক অাবুল কাশেম ফজলুল হক একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সঙ্গে অালাপকালে ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

ড. মুনতাসীর মামুন একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, অামরা সব সময় একটা অাশঙ্কার মধ্যে থাকি। অামরা যারা মুক্তিযুদ্ধের অাদর্শের পক্ষে লড়াই করি অামাদের যে কারো ওপর যে কোন সময় এ অাঘাতটা অাসতে পারে। শাহবাগ অান্দোলনের সময় থেকে নানা সময় নানাভাবে জঙ্গিরা অামাদেরকে হুমকি দিয়ে অাসছে।

ইতিহাস গবেষক এই প্রবীণ অধ্যাপক এ সময় বলেন, ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো মৌলবাদি জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের লক্ষ্যে স্থির। তারা চায়, অামরা অামাদের জায়গা থেকে সরে যাই। কিন্তু তা তো হবার নয়।

ড. মুনতাসীর মামুন অারও বলেন, ইতিহাস একদিন সাক্ষ্য দেবে অামরা প্রগতির পক্ষে এক ও ঐক্যবদ্ধ ছিলাম।
একের পর এক মুক্তমনা লেখকদের ওপর হামলা সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণ করে কী না এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, না, এমন ঘটনা অাগেও ঘটেছে। এটা নতুন বা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা সব সময় ছিল।

অান্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন অাফরোজ বলেন, এই ঘটনা অত্যান্ত দুঃখজনক ব্যাপার। কাপুরুষোচিতভাবে তাকে অাক্রমন করা হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা লড়ে সুনাম অর্জনকারী তুরিন অাফরোজ বলেন, এই অাক্রমন ব্যক্তি জাফর ইকবালের ওপর নয়, বরং এটা তার অাদর্শের ওপর অাক্রমন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তার যে অবস্থান, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তার যে অবস্থান, এটা সেই অবস্থানের ওপর অাক্রমন।

ব্যারিস্টার তুরিন অাফরোজ অারও বলেন, এই হামলা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, মুক্তচিন্তার পক্ষের লোকদের ওপর এধরনের হামলা চালানো হয়েছে। যারা এই হামলাগুলো করে তাদের লক্ষ্য সব সময় এক। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।

পর্দার অাড়ালের অপরাধীকে শনাক্ত করার দাবি জানিয়ে ব্যারিস্টার তুরিন অাফরোজ বলেন, যে ধরা পড়েছে সে চুনোপুঁটি। পর্দার অাড়ালের অাসল রাঘব বোয়ালদের শনাক্ত করা অাজ সময়ের দাবি।

তুরিন অাফরোজ অারও বলেন, এসব ঘটনার পর সব সময় নানা অপবাদ দিয়ে ঘটনাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়। সেদিকে সতর্ক খেয়াল রাখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোন লোকের শরীর থেকে যে রক্ত বের হয় তা বাংলাদেশের রক্ত।

মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারী করে ব্যারিষ্টার তুরিন অাফরোজ বলেন, অতীতে যে কোন সময় যুগের প্রয়োজনে, সময়ের প্রয়োজনে অামরা ঐক্যবদ্ধভাবে একমঞ্চে অাওয়াজ তুলেছি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণঅাদালত প্রতিষ্ঠার সময়, ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চে অামরা যেভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম, এখনো সময়ের প্রয়োজনে অামরা একইভাবে অান্দোলনের ডাক দেওয়ার প্রস্তুতি রাখি।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শফি অাহমেদ ও এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ও দোষীদের গ্রেফতার দাবি করেছেন। একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সঙ্গে অালাপকালে তিনি বলেন, অাদর্শগতভাবে অামি ও জাফর ইকবাল একই জায়গার মানুষ। তার ওপর বা অামাদের যে কারো ওপর যে কোন সময় হামলা হতে পারে এটা জানতাম। কিন্তু তার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা ঘটবে সেটা কখনো ভাবিনি।

অধ্যাপক শফি অাহমেদও অন্যদের মতো একই কথার পুণরাবৃত্তি করে বলেন, এই হামলা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, ইতোপূর্বেও এমন হামলা হয়েছে। এটাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই।

অধ্যাপক শফি অাহমেদ অারও বলেন, যদিও ভাগ্যক্রমে জাফর ইকবাল বেঁচে গেছেন, কিন্তু হামলা করা হয়েছিল হত্যার উদ্দেশ্যে। তাই পর্দার অাড়ালের অপরাধীকে শনাক্ত করা দরকার।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শওকত বাঙালী। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে অালাপকালে তিনি বলেন, ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

প্রগতিশীলতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীলদের চিরন্তন যে লড়াই, এটা তারই ধারাবাহিকতা।

শওকত বাঙালী অারও বলেন, যে সময় প্রতিক্রিয়াশীলরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে সে সময় প্রগতিশীলরা নানা মতবাদে বিভক্ত হচ্ছি। এটা দুঃখজনক। ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় অামরা সতর্ক হওয়া প্রয়োজন, অাদর্শের প্রয়োজনে অামাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

শওকত বাঙালী বিশ্বাস করেন, প্রশাসন তৎপর থাকলে, ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা সম্ভব।

সাংবাদিক ও লেখক নাজিয়া জাবীন। ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ড. জাফর ইকবাল একজন সজ্জন পরিচ্ছন্ন মানুষ। রাজনীতির নোংরামীতে তিনি নেই। লাভ লোকসানের ব্যবসায় নেই। তিনি লিখেন। বিজ্ঞান নিয়ে অান্দোলন করেন। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে যখন হামলা করা হয়, তখন বুঝতে হবে একটা গোষ্ঠী ড. জাফর ইকবালকে, তার কাজকে ভয় পায়। অার কাপুরুষরা পেছন থেকেই ছুরি মারতে অাসে।

নাজিয়া জাবীন অারও বলেন, অামরা এমন বিপদসঙ্কুল সমাজ চাই না। এমন অন্ধকার বাংলাদেশ চাই না। সময় অামাদের সতর্ক করে বলছে, অামাদের এখন ঐক্যবদ্ধভাবে অনেক কাজ করা দরকার।

ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে নাজিয়া জাবীন বলেন, একজন দু`জন হামলাকারী গ্রেফতার করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। বরং সামাজিকভাবে মৌলবাদের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অামাদের লড়াই চালাতে হবে।

উল্লেখ্য, শনিবার বিকেলে বিজ্ঞান পুরোধা ব্যক্তিত্ব, লেখক শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল নিজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে মারাত্মকভাবে অাহত হন। একটি অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠার সময় দুর্বৃত্তরা পেছন থেকে তার মাথায় ছুরিকাঘাত করে। প্রথমে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেলে নেওয়া হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ঢাকায় সিএমএইচে তার চিকিৎসা চলছে।

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.





© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি