খালা ও ইউনূস দ্বন্দ্বে, আমি শুধু ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ মাত্র : টিউলিপ
প্রকাশিত : ২১:৫১, ১০ আগস্ট ২০২৫ | আপডেট: ২২:১১, ১০ আগস্ট ২০২৫

গত বছর বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ঝড়ে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। তার ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক, যিনি যুক্তরাজ্যের নাগরিক এবং দেশটির সংসদের সদস্য। ৪২ বছর বয়সী টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। দুর্নীতির অভিযোগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্রিটেনের মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠনের খবর তিনি মাত্র এক সপ্তাহ আগে তার আইনজীবীর মাধ্যমে জানতে পারেন। অভিযোগ অনুসারে, তিনি তার খালা—বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগসাজশে ঢাকার পূর্বাচলে তার মা, ভাই ও বোনের নামে প্রভাব খাটিয়ে জমি অধিগ্রহণ করেছেন।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এসব অভিযোগ ‘পুরোপুরি অবাস্তব।’
আগামীকাল সোমবার (১১ আগস্ট) ঢাকার আদালতে টিউলিপসহ আরও ২০ জনের বিরুদ্ধে এই মামলার শুনানি শুরু হবে। সশরীরে বা ভিডিওলিংকের মাধ্যমে তিনি এই শুনানিতে অংশ নেবেন কি না?
জবাবে টিউলিপ বলেন, ‘আমি হোগো কিথ কেসির কাছ থেকে আইনি পরামর্শ নিচ্ছি। আমার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত সেটা তাদের পরামর্শের আলোকে নির্ধারণ করা হবে।’
তিসি বলেন, আদালতে হাজির হতে ‘আনুষ্ঠানিক সমন’ পাননি তিনি। তাঁর ‘বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ আনা হয়েছে’ তা তিনি ‘এখনো জানেন না।
এই ব্রিটিশ এমপি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, আমি যেন এক চরম অস্বস্তিকর দুঃস্বপ্নে আটকে গেছি, যেখানে আমাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। অথচ আমি এখনো জানতে পারিনি, অভিযোগটা কী বা এই বিচার আসলে কী নিয়ে।’
বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, প্রয়োজনে টিউলিপের অনুপস্থিতিতেই বিচার চলবে। টিউলিপ দোষী সাব্যস্ত হলে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে প্রত্যর্পণ ইস্যু সামনে আসবে। তবে ব্রিটেনের সাবেক মন্ত্রী বলেন, ‘আমি নিজে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এমন কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই।’
টিউলিপ যে দেশের নাগরিক, তার থেকে প্রায় ৫০০০ মাইল দূরের বাংলাদেশে টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন তাঁর খালা শেখ হাসিনা। কিন্তু গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাসিনার শাসন ভেঙে পড়ে। টানা দেড় দশকের শাসনামলে ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে থাকা হাসিনা নির্মম প্রাণঘাতী উপায়ে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। যখন তাঁর সরকারের পতন হয়, তখন তাঁর সঙ্গে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন টিউলিপের মা শেখ রেহানা। পরে হাসিনা ও রেহানা দুজনই ভারতে চলে যান।
টিউলিপ জানান, সেই সময়টা ছিল ঢাকায় অবস্থান করা তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য সত্যিকারের ভয়াবহ সময়। তবে ব্রিটেনে টিউলিপের স্বামী, দুই সন্তানের জীবন তাতে খুব একটা বাধাগ্রস্ত হয়নি। সবকিছুই ছিল তাদের জন্য স্বাভাবিক।
শেখ হাসিনার প্রসঙ্গে টিউলিপ বলেন, ‘আমি এখানে আমার খালাকে রক্ষা করার জন্য আসিনি। আমি জানি, তাঁর সরকারি দায়িত্ব কীভাবে পরিচালিত হয়েছে, কীভাবে শেষ হয়েছে তার প্রক্রিয়া নিয়ে তদন্ত চলছে। আর আমি সত্যিই আশা করি, বাংলাদেশের মানুষ যে পরিসমাপ্তি চান, তারা যেন তা পায়।’
হাসিনার পতনের পর তাঁর এবং টিউলিপের বিরুদ্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার তছরুপের অভিযোগ ওঠে। একটি ছবিকে কেন্দ্র করে এই অভিযোগের পালে হাওয়া লাগে। ছবিটিতে দেখা যায়, শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে রাশিয়া সফরকালে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বসে আছেন। তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন হাস্যোজ্জ্বল টিউলিপ সিদ্দিক। তবে খালার সঙ্গে জড়িয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগকে তিনি ‘নোংরা রাজনীতি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এই ছবির বিষয়ে টিউলিপ বলেন, ‘আমার খালা রাশিয়ায় সরকারি সফরে গিয়েছিলেন। আমি ও আমার বোন লন্ডন থেকে রাশিয়ায় তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি কোনো রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নিইনি। আমরা ভ্রমণ করেছি, মজা করেছি, রেস্টুরেন্টে গেছি, শপিং করেছি। সফরের শেষ দিনে, সেখানে উপস্থিত সব রাজনীতিবিদদের পরিবারের সদস্যদের চা পান ও এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে ছবিও তোলা হয়েছিল। আমি দুই মিনিটের জন্য পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম।’
তবে কেবল এই অভিযোগই নয়, টিউলিপের বিরুদ্ধে পরে কিংস ক্রসে ২০০৪ সালে একটি ফ্ল্যাট গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। বলা হয়, এই ফ্ল্যাটটি হাসিনার দল আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তির। টিউলিপ জানান, ফ্ল্যাটের আগের মালিক তাঁর ‘ধর্মপিতা’ এবং তাঁর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তবে এর আগে, টিউলিপ দুই বছর আগে একটি সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেছিলেন, এই ফ্ল্যাট তাঁকে তাঁর বাবা-মা কিনে উপহার দিয়েছিলেন।
এরপর, প্রশ্ন ওঠে টিউলিপ কেন ক্রিকলউডে থাকা নিজের বাড়ি রেখে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রোপার্টি ডেভেলপারের নামে থাকা একটি বাড়িতে বসবাস করছেন? এই বিষয়ে তিনি দাবি করেন, ওই ব্যক্তিকে তিনি লেবার পার্টির মাধ্যমেই চিনেছিলেন। টিউলিপ জানান, তাঁর নিরাপত্তা হুমকি রয়েছে বলে সতর্ক করা হয়েছিল। তাই তিনি নিজ বাড়ি ছেড়ে ওই বাড়িতে উঠেছিলেন।
টিউলিপ জানান, বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির এমপি ডেভিড অ্যামেস তাঁর কর্মস্থলে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে তাঁকে স্থানান্তরিত হতে বলা হয়। এই পরিস্থিতিতে তিনি সেই পরিচিত ব্যক্তির ওপর নির্ভর করেন। তিনি জানান, তিনি বাজার মূল্য অনুসারেই ভাড়া দিয়েছেন। এবং এই বিষয়ে প্রশ্ন ওঠার পর তিনি নিজেই বিষয়টি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নৈতিকতা বিষয়ক উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাসের কাছে উপস্থাপন করেন।
দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ‘ব্যাপক’ বৈঠক শেষে লরি ম্যাগনাস টিউলিপ সিদ্দিককে মন্ত্রিসভার আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেন। তবে ম্যাগনাস যোগ করেন, ‘তিনি তাঁর পারিবারিক সম্পর্ক এবং সরকারি ভূমিকার কারণে সম্ভাব্য মানহানির ঝুঁকি সম্পর্কে যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন না, এটি দুঃখজনক।’ তবে এই বিষয়ে টিউলিপ কিছুটা বিরক্ত। তিনি বলেন, ‘আমি তো আমার খালার পরে জন্মেছি, সেটা তো আমি বদলাতে পারি না। এটা অদ্ভুত কথা! যেন বলা হচ্ছে—তোমাকে তোমার জন্মের ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত ছিল।’
টিউলিপের দাবি, তবে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের পালা থামেনি। তাঁর আইনজীবীরা তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে স্পষ্টতা চাইলেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি—বলেও অভিযোগ করেন টিউলিপ। তিনি এ বছর যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন। তবে ড. ইউনূস তা নাকচ করে বলেন, এটি বিচারিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে।
এদিকে, যুক্তরাজ্যের অপরাধ তদন্ত সংস্থা লন্ডনে হাসিনার সঙ্গে যুক্ত দুই ব্যক্তির প্রায় ৯০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি জব্দ করেছে। জব্দ করা সম্পত্তির মধ্যে একটি বাড়িও রয়েছে, যেখানে টিউলিপের মা শেখ রেহানা বসবাস করতেন এবং এখনো তাঁর কিছু জিনিসপত্র সেই বাড়িতে রয়েছে। টিউলিপ দাবি করেন, এটার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।
টিউলিপ বলেন, টিউলিপ বলেন, ‘বাংলাদেশের কিছু লোক ভুল করেছে এবং তাদের শাস্তি পাওয়া উচিত। কিন্তু আমি তাদের মধ্যে নই। সত্য হলো, আমি শুধুই কোল্যাটারাল ড্যামেজ। কারণ, আমার খালার সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের শত্রুতার পরিণতি এটা। এ ক্ষেত্রে আমি যে বড় শক্তির সঙ্গে লড়াই করছি, তাতে সন্দেহ নেই।’
এসএস//
আরও পড়ুন