জাকসু নির্বাচন: পাঁচ কারণে ছাত্রদলের ফলাফল তলানীতে
প্রকাশিত : ১৫:২৯, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ও হল শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন শেষ হলেও আলোচনা-সমালোচনা যেন পিছু ছাড়ছে না। ইতিমধ্যে এ নিয়ে নানা হিসেব নিকেশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। সবচেয়ে বেশি আলোচনা ছাত্রদলের ফলাফল নিয়ে।
সাধারণ থেকে সংগঠন, রাজনীতিবিদ সকলের মনেই প্রশ্ন- সাংস্কৃতিক নগরে কিভাবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মতো সংগঠনের ফলাফল তলানীতে?
একুশে টেলিভিশনের প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে অনেকাংশে বেরিয়ে এসেছে এর অভ্যন্তরীণ কারণ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পাঁচ কারণে জাকসুতে ছাত্রদলের ফলাফলের এই অবস্থা। কারণগুলো হলো; দলের অভ্যন্তরে নিয়ন্ত্রণহীন একাধিক গ্রুপ, সমন্বয়হীনতা ও বিশ্বাসহীনতা, পরিকল্পনার অভাব, স্বল্প সময়ে প্রার্থীতায় নতুন মুখ ও নারীদের সংশ্লিষ্টতা কম।
এই পাঁচ কারণেই মূলত জাকসুর ফলাফলে তলানীতে ছাত্রদল। তবে ছাত্রদল নেতারা এ সকল অভিযোগ বা কারণ মানতে নারাজ। তাদের স্পষ্ট কথা সুকৌশলে অনিয়ম ও ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে এ ফলাফল করা হয়েছে। এ জন্য ভোট বর্জন করা হয়েছে, ছাত্রদল হারেনি।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সম্প্রতি ২১টি হলে হল কমিটি ঘোষণা করায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টি হয়। আর এর ফলে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয় ছাত্রদল। যদিও একাধিক মিটিং ও আলোচনায় বিভক্ত দূরিকরণের উদ্যোগ নেয় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাসহ দলের হাইকমান্ড। এতে উপরিভাগে ঐক্যবদ্ধ’র প্রলেপ পড়লেও অভ্যন্তরে ক্ষোভ ও বিভেদ পুষে রাখে নেতাকর্মীরা।
বিভেদে কারা জড়িত? সে খবর চলে যায় বিরোধী মত ও দলের কাছে। তারা বিভেদটাকে জিইয়ে বা চাঙ্গা রাখতে কাজ করে। নির্বাচনী কৌশল হিসেবে সুযোগ নেন এই বিভেদের। যার প্রভাব পরে নির্বাচনে।
জাকসু নির্বাচনে ফলাফলে দেখা যায়, হল সংসদে ৩০টির মতো পদে বিজয়ী হন ছাত্রদল সমর্থিতরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাজউদ্দিন হল, কাজী নজরুল ইসলাম হল ও মীর মশাররফ হোসেন হলের একাধিক ছাত্রদল নেতৃবৃন্দ জানিয়েছে, ভোট বর্জন না করলে হল সংসদে আরও পদে বিজয়ী হতে পারত ছাত্রদলের আরও কয়েকজন।
প্রশ্ন উঠেছে সেখান থেকেই। হল সংসদে বিজয়ী হলে কেন কেন্দ্রীয় সংসদে কোন পদে বিজয়ী হতে পারেনি ছাত্রদল? অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংয়ের ব্যাপারটি স্পষ্ট হয় এখান থেকে। আর এ সকল কাজে নিয়োজিত সমন্বয়ক হিসেবে সিনিয়র নেতাদের নির্দেশনা উপেক্ষিত ছিল বলে জানা যায়।
শাখা ছাত্রদলের নেতৃত্বে সিনিয়রদের অর্ন্তভুক্তিতে আগে থেকেই দলের ভেতরে ক্ষোভ ছিল অনেকের। তাই নির্বাচনের সময় সকল শাখাতেই সমন্বয়হীনতার কথা বলেন অনেকে। এই সমন্বয়হীনতায় একে অপরকে সন্দেহ ও কোনঠাসা করতে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করে মনোমালিন্য ও বিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি করে। যার প্রভাবও নির্বাচনে পরে।
তৃতীয় কারণটি হলো দলটির মধ্যে সঠিক পরিকল্পনার অভাব। আগে থেকেই জাকসু নির্বাচন হবে কি না- তা নিয়ে ধোয়াশা তৈরি হয়। একাধিকবার তফসিল ঘোষণায় বিভ্রান্ত হয় রাজনৈতিক পরিকল্পনায়। আর এ কারণেও সঠিক পরিকল্পনায় ভাটা পরে বলে জানা যায়।
শাখা ছাত্রদলের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃত্বে ছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গড়া কমিটি। দীর্ঘদিনের পরিক্ষীত ও ত্যাগী হওয়ায় তাদের উপর ভরসা রেখে এ কমিটি দেওয়া হয়। তবে জাকসু নির্বাচন ঘোষিত হলে চলমান শিক্ষার্থীর মনোনয়নে নেতৃত্বের সংকট দেখা দেয়। এ জন্যই নির্বাচনকালীন সময়ে একাধিক প্রার্থীর নাম শুনলেও শেষ মুহূর্তে প্যানেল ঘোষণা করা হয় নতুন প্রার্থীদের দিয়ে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে এদের পরিচিত ছিল কিছুটা কম। আর এতেই বিপক্ষ প্যানেলগুলো থেকে পিছিয়ে পরে তারা, জানান ওই সকল নেতৃবৃন্দ।
অনুসন্ধানের শেষ কারণটি হলো নারীদের অর্ন্তভুক্তি ছিল খুবই কম। কেন্দ্রীয় সংসদে জিএস সহ সাতজন নারী প্রার্থী প্যানেলে অর্ন্তভুক্ত হলেও হল সংসদের অনেক হলে কোন প্রার্থীই ছিলনা তাদের। তাই প্রায় ৫০ শতাংশ নারী ভোটারদের এই নির্বাচনে ছাত্রদলের এখানে খুবই নাজুক অবস্থা ছিল। যার প্রভাব ভোটের ফলাফলেও পরেছে।
আর এসব কারণেই হয়তো ভোটের হিসেবে অনেকটা তলানীতে ছিল ছাত্রদলের প্যানেল। কেন্দ্রীয় সংসদের ২৫টি পদের একটিতেও বিজয়ী হতে পারেননি তারা। যদিও ৩৩ বছর আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ্যতায় ১৯৯২ সালের সর্বশেষ জাকসু বিজয়ীসহ আগের ৮ বারের অধিকাংশের ফলাফলই বিজয়ী ছাত্রদলের সোনালী অতীতকে মনে করিয়ে দিতে পারে।
তবে এবারের নির্বাচনীর পোর্স্ট মর্টেম বলছে ভিন্ন কথা।
বিষয়টি মানতে নারাজ ছাত্রদল প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ সাদী হাসান। তিনি বলেন, এখানে অনিয়ম ও কারচুপির মাধ্যমে ভোট কার্যকর করায় আমরা ভোট বর্জন করেছি। জয়-পরাজয়ের হিসেবটা হতো তখনই যখন সুষ্ঠুভাবে ভোট ও নির্বাচন পরিচালিত হতো।
প্রায় একই রকম কথা বলেন শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোঃ বাবর। তিনি বলেন, যেখানে ভোট বর্জন হয়েছে সেখানে জয় পরাজয়ের প্রশ্ন অবান্তর। তবে গ্রুপিংয়ের ব্যাপারে বলেন, বড় দলে কিছুটা মতভেদ থাকবেই। তাতে নির্বাচনে কোন প্রভাব পরেনি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জাবি ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান অভি বলেন, প্রশাসনের নির্লজ্জ পক্ষপাতদুষ্টু বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণেই ছাত্রদলের এ অবস্থা।
এ ব্যাপারে বিএনপি শিক্ষক ও নির্বাচনী দায়িত্বে রিটার্নিং কর্মকর্তা থেকে পদত্যাগ করা অধ্যাপক মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, এখানে বিভিন্ন অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে। যা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সে সকল কিছু এড়িয়ে প্রশাসন একটি দুরভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করায় সেখান থেকে সরে আসি। তাই ফলাফল বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত দেওয়া সমীচিন নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জাকসুর ফলাফল নিয়ে এখনও সর্বত্র হচ্ছে আলোচনা। অভ্যন্তরে হচ্ছে সমালোচনা। নতুন কৌশল আটছে সংশ্লিষ্টরা। সামনে এ সংগঠনটি কি পদক্ষেপ নেন সেটিই এখন দেখার বিষয়।
এএইচ
আরও পড়ুন