বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী : পিকেএসএফ
প্রকাশিত : ২০:৩১, ১৮ জুলাই ২০১৭ | আপডেট: ১৭:৫০, ১৯ জুলাই ২০১৭

উন্নয়নের বহুমাত্রিক ধারণার সম্পৃক্ততার অংশ হিসেবে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর সহযোগী সংস্থাসমূহের সুবিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এগিয়ে আসছে। এতে গ্রামীণ পর্যায়ে বাল্যবিবাহ কমে আসছে। পিকেএসএফের এক প্রতিবেদনে এমনই তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১৩ সালে ‘‘সোশ্যাল এ্যাডভোকেসি এ্যান্ড নলেজ ডিসেমিনেশন’’ ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই ইউনিটটি অন্যান্য জনসচেতনতামূলক কাজের পাশাপাশি পিকেএসএফ-এর সমৃদ্ধি কর্মসূচিভুক্ত ১৬টি ইউনিয়নে নারী ও শিশুর অধিকার রক্ষায় বিশেষ করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বৃহৎ পরিসরে জনসচেতনতা বৃদ্ধির একটি পূর্বশর্ত হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই দিকটি বিবেচনা করে পিকেএসএফ সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারপার্সন, শিক্ষক, ইমাম, কাজী, যুবসমাজের প্রতিনিধি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ ২১২৮ জনকে ‘‘সামাজিক উন্নয়ন ও দায়বদ্ধতা ’’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ে আলোচনা সভা, প্রশিক্ষণ ও এ্যাডভোকেসি কর্মশালা চলমান রয়েছে। ১৬ ইউনিয়নে ৪০টি মাধ্যমিক ও সমমানের স্কুলের ৫৯৫ জন শিক্ষক ও ১০,২৩৫ জন ছাত্র ও ছাত্রীকে ওরিয়েন্টেশন প্রদান করা হয়েছে, যা এখনও চলমান রয়েছে। এছাড়া সহায়তা করা হয়েছে ‘‘কিশোরী ক্লাব’’ গঠনে যা বাস্তবে বাল্যবিবাহ রোধে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে এবং সমবয়সীদের মাঝে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করাতেও সহায়তা করছে। এর পাশাপাশি যুবসমাজও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে।
এ সকল কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে ২০১৭ সালের জানুযারি থেকে মে পর্যন্ত ২০টি বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ আব্দুল খালেক ও রোজিনা দম্পতির ১৪ বছর বয়সী মেয়ে সোহাগী জীবননগর উপজেলার সীমান্ত ইউনিয়নের গয়েশপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। মেধাবী সোহাগীর স্বপ্ন উচ্চ শিক্ষিত হয়ে শিক্ষক হওয়ার। লেখাপড়ায় ভালো বিধায় ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের মাঝে সে জনপ্রিয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন তাদের বাড়িতে বিয়ের জন্য পাত্র পক্ষ হাজির হয়। তারা সোহাগীর মাকে প্রায় বোঝাতে সক্ষম হয় যে এই পাত্রের সাথে সোহাগীর বিয়ে হলে সে সুখী হবে। সোহাগীর এই বিয়েতে অসম্মতি থাকলেও সে তার মাকে এই বিয়ে থেকে বিরত রাখতে পারে না। সোহাগী উপায়ন্তর না পেয়ে তার বন্ধুদের সাথে বিষয়টি আলোচনা করে। তারা কিছুদিন আগেই পিকেএসএফ-এর সহযোগী সংস্থা ‘‘ওয়েভ ফাউন্ডেশন’’ দ্বারা পরিচালিত ‘‘বাল্যবিবাহ রোধে করণীয়’’ শীর্ষক ওরিয়েন্টেশনে অংশ নিয়েছিল। তারা দ্রুত বিষয়টি গ্রামের সমৃদ্ধির ওয়ার্ড কমিটি, স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটি এবং শিক্ষকদের দৃষ্টিগোচর করে। ফলশশ্রুতিতে তারা সোহাগীর জীবনে ভবিষ্যতে যে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে সেটি বোঝাতে সক্ষম হয়। সোহাগীর মা-বাবা বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে এবং সম্মিলিত উদ্যোগে বিয়েটি বন্ধ হয়। সোহাগী এখন তার ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য আন্তরিকতা দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বিজ্ঞপ্তিতে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে জয়পুরহাটের খেতলাল উপজেলার বড়তারা ইউনিয়নের ১৫ বছর বয়সী কিশোর রকি চন্দ্র মালীর জীবনে। বাবা গিরেন চন্দ্রের বড় ছেলে রকি বরাবরই বাবা-মার কাজে সহযোগিতা করে। দারিদ্রতা এবং অজ্ঞানতাবশত হঠাৎ রকির দাদীর মাথায় বুদ্ধি আসে সে যদি তার নাতীকে বিয়ে দেয় তাহলে যৌতুকের টাকা দিয়ে তাকে একটি ব্যবসা ধরিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু রকির সম্মতি না থাকা সত্ত্বেও পরিবারের চাপে তাকে অবশেষে বিয়েতে রাজি হতে হয়। গ্রামে খবরটি ছড়িয়ে পড়লে পিকেএসএফ-এর সমৃদ্ধি কর্মসূচির শিক্ষা সহায়তা কেন্দ্রের শিক্ষিকা শাহজাদী ‘‘এহেড সোশ্যাল অর্গানাইজেশন (এসো)’’ কে অবগত করেন। ‘‘এসো’’ এর প্রতিনিধি বিয়েটি বন্ধ করতে রকির পরিবারকে বোঝনোর চেষ্টা করে। কিন্তু এতে কাজ না হওয়ায় অবশেষে তারা সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানায়। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিয়েটি বন্ধ করে দেন।
বাল্যবিবাহের নেতিবাচক দিকগুলো বুঝতে পেরে বিদ্যমান আইনকে সম্মান জানিয়ে পরিবারটি এই বিয়ে থেকে সরে আসে এবং রকি স্বাবলম্বী হয়ে উপযুক্ত বয়সে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সকলের সমন্বিত উদ্যোগ, সহযোগী সংস্থাসমূহের ‘‘সমৃদ্ধি’’ কর্মসূচির কর্মীবৃন্দের সহযোগিতা এবং সোশ্যাল এ্যাডভোকেসি এ্যান্ড নলেজ ডিসেমিনেশন ইউনিটের নির্দেশনায় সমাজে বাল্যবিবাহ রোধের প্রক্রিয়া বেগবান হচ্ছে। মানুষের মাঝে প্রথাগত ধ্যান ধারণায় পরিবর্তন আসছে যে সুশিক্ষিত কন্যাসন্তান পরিবারের জন্য সম্পদ।
আরকে/ডব্লিউএন
আরও পড়ুন