ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গা নিধনের এক বছর

‘বৃষ্টিতে গাছের ওপর সারারাত কাটত’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:২৮, ২৫ আগস্ট ২০১৮

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধন থেকে প্রাণে বাঁচতে দু’মাস আগে স্বামীর সঙ্গে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন হামিদা বেগম। সঙ্গে ছিল দুই বছর আর তিন মাস বয়সী দুই সন্তান। যেদিন তারা পালান তার অন্তত এক সপ্তাহ আগে থেকে চোখে ঘুম ছিল না গোটা পরিবারের। মৃত্যু আতঙ্কে পালিয়ে থাকতে হতো।

বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরের কুঁড়েঘরে বসে রয়টার্সের প্রতিনিধিকে ১৮ বছরের এই নারী বলেন, ‘গাছের ওপরে উঠে সারা রাত বসে থাকতে হতো তাকে। এমনকি বৃষ্টি হলেও নামতে পারতো না।’

রয়টার্স জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা স্রোত এখনও বন্ধ হয়নি। হামিদার মতো বহু নারী পুরুষ এখনও বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিচ্ছে। চলতি আগস্টেও রাখাইন থেকে পালিয়ে এসেছে অন্তত ১৫০ জন। মিয়ানমার থেকে এই বছরের পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের সংখ্যা অন্তত ১৩ হাজার।

রোহিঙ্গা সংকটের এক বছর পূর্তির আগে গত মঙ্গলবার এক ভাষণে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের দায়িত্ব বাংলাদেশের। অথচ তার মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেছেন, এক বছর পরেও রাখাইনের পরিস্থিতি পাল্টায়নি।

নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর গত বছর ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাবিরোধী সেনা অভিযান শুরু করেছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থা। খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘ ওই অভিযানকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ আখ্যা দেয়। তবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ একে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বৈধ অভিযান আখ্যা দিয়ে আসছে।

দুই মাস আগে রাখাইন ছেড়ে আসা হামিদা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরের এক প্রান্তে বাস করেন, যেখানে মিয়ানমারের সেনা অভিযানের পর পালিয়ে আসা সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাস করছেন।

 

মিয়ানমার বলছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তারা প্রস্তুত। তবু রাখাইন ছেড়ে এখনও হামিদাদের মতো রোহিঙ্গা পরিবারের পালিয়ে আসতে থাকা প্রমাণ করে সেনা অভিযানের এক বছর পরেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

সীমান্ত পাড়ি দেওয়া রোহিঙ্গাদের ঢল মিয়ানমারে বিকশিত হতে থাকা গণতন্ত্রকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশটির নোবেল জয়ী নেত্রী অং সান সু চির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের সাবেক কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক রিচার্ড হর্সি মন্তব্য করেছেন, ‘এই সংকট বিশ্বে মিয়ানমারের অবস্থানের ভয়ঙ্কর ক্ষতি করেছে।’

সু চির সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উত্থাপিত প্রায় সব অভিযোগই প্রত্যাখ্যান করেছে। শরণার্থীদের জন্য পশ্চিম রাখাইনে নির্মাণ করেছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কেন্দ্র। তবে হামিদা ও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পৌঁছানো রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে, এই সংকটের আশু সমাধান এখনও সুদূরপরাহত।

নতুন আসা এসব শরণার্থীর ছয়জন রয়টার্সকে বলেছেন, পুড়িয়ে দেওয়া বাড়ি আর শূন্য গ্রামগুলোতে টিকে থাকতে কয়েক মাস ধরে সংগ্রাম করলেও নির্যাতন আর নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তারা। এসব রোহিঙ্গা বলছে, বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ায় তারা অনাহারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। তারা নিজের খামারে যাওয়া, বাজারে যাওয়া, মাছ ধরতে পুকুরে যাওয়া, এমনকি নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার মতো কাজও করতে পারছিল না।

শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় কক্সবাজারের পাহাড়গুলোকে সাদা, কমলা আর নীল রংয়ের কুঁড়েঘরের সীমাহীন সমুদ্রে পরিণত করেছে। এসব কুঁড়েঘরের বাসিন্দারা দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে বসবাসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

হামিদার কুঁড়েঘরের পাশে রোহিঙ্গা পুরুষেরা ইট বয়ে এনে ৪ মিটার গভীর ল্যাট্রিন তৈরি করেছে। শক্ত মাটি বসিয়ে চারপাশে বেড়া দিয়ে এনজিও পরিচালিত একটি স্কুল চালু করা হচ্ছে। কাঠ, বাঁশের খুঁটি বসিয়ে তার ওপরে ত্রিপল বিছিয়ে নতুন আসা শরণার্থীদের জন্য তৈরি হচ্ছে আশ্রয়।

হামিদা জানান, গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত উত্তর রাখাইনে তাদের গ্রামে অন্তত ৫ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করতো। দুই মাস আগে যখন তারা পালিয়ে আসে তখন সেখানে মাত্র ১শ’ জনের মতো ছিল।

হামিদার দেওয়া তথ্য স্বাধীনভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি রয়টার্স। তবে সাক্ষাৎকারের সময় তার পাশে থাকা আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা তার এই তথ্যে সমর্থন দিয়েছেন।

হামিদারা রাখাইনে থেকে গিয়েছিল। কারণ, তাদের কাছে বাংলাদেশে আসার মতো পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। হামিদা জানান, প্রথম কয়েক মাসের সেনা অভিযানের পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ঘন ঘন তাদের গ্রামে টহল দিয়েছে। রোহিঙ্গা পুরুষদের গ্রেফতার করেছে বা সেনা ক্যাম্প বানাতে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে নিয়েছে।

হামিদা বলেন, মিয়ানমারে রাতে যদি ছেলেমেয়েরা কেঁদেও উঠতো তাহলেও আমি মোমবাতি জ্বালাতে পারতাম না। পুরো গ্রামে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে, মোমের আলো দেখতে পেলেও সেনা সদস্যরা এসে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে পারে।’

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর গত সপ্তাহে দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলেছে, নতুন আসা শরণার্থীদের প্রায় অর্ধেকই জানিয়েছেন, মিয়ানমারে থাকা তাদের আত্মীয়রাও আতঙ্কের কারণে পালিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে।

শরণার্থী শিবিরে ইউএনএইচসিআর’র প্রতিনিধি ক্যারোলিন গ্লুক বলেন, ‘মানুষ আমাদের বলেছে, সেখানে যেন তারা কারাগারে আছে। তারা বাড়ি থেকে বের হতে পারেন না। মাছ ধরতে যেতে পারেন না। কারফিউ। এমন কড়াকড়ি যে মাত্র নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টা আগুন জ্বালাতে পারেন তারা।’

এসব বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বারবার ফোন করা হলেও সু চির মুখপাত্রকে পায়নি রয়টার্স। এনএলডি মুখপাত্র মিয়ো নুয়ান্ট স্বীকার করেন, জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনার এক বছর আগে রাখাইনে সহিংসতায় ইন্ধন জোগানো হয়েছিল। সেই উত্তেজনা এখনও বহাল রয়েছে। ১৯৮০ দশকে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকার কেড়ে নেয়। গত বছরের অক্টোবরে জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, এরপর ধাপে ধাপে সামরিক প্রচারণা চালিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের রোহিঙ্গাবিদ্বেষী করে তোলা হয়।

মিয়ো নুয়ান্ট বলেন, এক বছর পরে সেখানকার পরিস্থিতি পাল্টায়নি। মিলেমিশে বসবাস করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে সময় লাগবে।

সূত্র : রয়টার্স।

/ এআর /


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি