ঢাকা, শুক্রবার   ০৯ মে ২০২৫

অ্যাপের ফাঁদে সর্বশান্ত রাজশাহীর হাজারও মানুষ

বদরুল হাসান লিটন, রাজশাহী থেকে

প্রকাশিত : ০৯:৫৯, ২২ জুলাই ২০২৩

Ekushey Television Ltd.

রাতারাতি ধনি হওয়ার স্বপ্নে বিদেশি অ্যাপে টাকা বিনিয়োগ করে সর্বশান্ত হচ্ছেন রাজশাহীর হাজারও মানুষ। মহানগরীসহ জেলার গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে ‘অ্যাপের ফাঁদ’। যেখানে প্রতিদিন বিভিন্ন অ্যাপে বিনিয়োগ করে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনেকে অফিস খুলে চালাচ্ছেন এই প্রতারণা কার্যক্রম।

সম্প্রতি এ নিয়ে রাজশাহী নগরীর দুটি থানায় মামলা হলে পুলিশ এই প্রতারক চক্রের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা এখন কারাগারে। তবে থেমে নেই অ্যাপ প্রতারক চক্রের কার্যক্রম। প্রতিদিনই লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করছে নতুন নতুন অ্যাপে। বর্তমানে রাজশাহীতে বিনিয়োগের শীর্ষে রয়েছে ‘এমটিএফই’ নামের একটি অ্যাপ। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী নগরীর ডাঁশমারী পূর্বপাড়া এলাকার টাইলস মিস্ত্রি সবুজ আলী (২৩) ‘আলটিমা ফার্ম ও ওয়ালেট অ্যাপ’-এ এক লাখ ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। আজীবন লভ্যাংশ পাবেন এমন প্রলোভনে গত বছরের নভেম্বরে একই এলাকার মনসুর রহমানের ছেলে মাহবুবুর রহমান মোনায়েমের (২৩) মাধ্যমে সবুজ আলী এ অর্থ বিনিয়োগ করেন। এ জন্য সবুজ আলী তার মা সাবিয়া বেগমের নামে এনজিও থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন। বাকি ৪০ হাজার টাকা তাদের বাড়িতে ছিল। 

বিনিয়োগের পর প্রথম মাসে সবুজ আলী আট হাজার টাকা লভ্যাংশ পান। এরপর থেকে আর কোন টাকা পাননি তিনি। সর্বশেষ গত ২০ জুন নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার উপশহর ৩নং সেক্টরের মাহবুবুর রহমানের প্ল্যাটিং কয়েন নামের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেটি বন্ধ পায়।

এরপর সবুজ আলী খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ডাঁশমারী পূর্বপাড়া এলাকার শাহ জালালের ছেলে একলাসুর রহমান (২৫), মৃত আজিম উদ্দিনের দুই ছেলে লিটন ইসলাম (২৮) ও টিটু ইসলাম (৩৮) এবং শ্যামপুর পশ্চিমপাড়ার মৃত কুরবান আলীর ছেলে সিটন (২৫) এই চারজন মিলে ওই অ্যাপে ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে।

গত ২৬ জুন সবুজ আলী প্রতারক চক্রের আটজনের নাম উল্লেখসহ ১৩ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। এরপর পুলিশ অভিযান চালিয়ে প্রথমে মাহবুবুর রহমান ও তার সহযোগি হৃদয় ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাদের দেয়া তথ্যে আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

একই ভাবে ‘‘মুভি অ্যাপ’’ নামের আরেকটি অ্যাপে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারণার শিকার হয়েছে শত শত মানুষ। মুভি অ্যাপের রাজশাহীর মহানগরীর শিরোইলে অফিস খুলে মানিক নামের এক যুবক এই প্রতারণার কার্মকাণ্ড চালায়। ওই অ্যাপে গোদাগাড়ীর প্রেমতলী এলাকার শতাধিক মানুষ বিনিয়োগ করে প্রতারণার শিকার হয়। এ নিয়ে নগরীর চন্দ্রীমা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরেকটি মামলা হয়। এ মামলার পর মানিক গ্রেপ্তার হয়।

অনুসন্ধানে জানান গেছে, ফেসবুক প্রোফাইলে নিউজ ফিডে বিভিন্ন অ্যাপের এ্যাড দেখা যায়। এর মধ্যে বর্তমানে রাজশাহীতে জনপ্রিয়তার র্শীষে রয়েছে এমটিএফই নামের একটি অ্যাপ। এ অ্যাপে টাকা বিনিয়োগ করলে দ্রুত কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মানুষের কাছে প্রচার করছে কিছু যুবক। 

এমটিএফই এ অ্যাপের রাজশাহী নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় অফিস নিয়ে বসেছে রাজপাড়া মহল্লার সবুজ নামের এক যুবক। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় তার রয়েছে প্রতারক টিম। তাদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে অ্যাপে টাকা বিনিয়োগ করে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন ও প্রলোভন দেখাচ্ছে। তাদের ফাঁদে পা দিয়ে ওই অ্যাপে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে সাধারণ মানুষ।

জানা গেছে, বর্তমানে চালু থাকা এমটিএফই অ্যাপে একাউন্ট চালু করার সময় সর্বনিম্ন ৫০০ ডলারের সমপরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এ অর্থ বিনিয়োগ করলে সপ্তাহে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা লভ্যাংশ পাওয়ার প্রলোভন দেয়া হচ্ছে। আর লাভের আশায় রাজশাহীর হাজারও মানুষ টাকা বিনিয়োগ করছে ওই অ্যাপে। স্কুল কলেজের ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ বর্তমানে এমটিএফই অ্যাপে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। 

এমটিএফই অ্যাপে টাকা বিনিয়োগ করেছেন রাজশাহীর দূর্গাপুর উপজেলার দেলুয়াবাড়ি গ্রামের যুবক রুবেল হোসেন এক সময় কাঠমিস্ত্রী ছিলেন। পরে তিনি রাজশাহী নগরের আরডিএ মার্টেকের একটি কুকারিজের দোকানের কর্মচারি হিসেবে চাকরি করতেন। সম্প্রতি তিনি এমটিএফই অ্যাপে বিনিয়োগ করেন। এখন চাকরি ছেড়ে অ্যাপ প্রতারণা চক্রে জড়িয়ে পড়েছেন।

রুবেল হোসেন বলেন, আমার মাধ্যমে যদি কেউ অ্যাপে টাকা বিনিয়োগ করে তার কিছু কমিশন আমার একাউন্টে জমা হয়। যত বেশি টাকা বিনিয়োগ করবে ততো বেশি কমিশন পাবো। এভাবে যদি ১০০ জনকে বিনিয়োগ করাতে পারি তাহলে নিজেই অফিস করতে পারবো ও আমার পদ হবে সিও। দুর্গাপুর এলাকার অর্ধশত বিনিয়োগকারি তার মাধ্যমে এমটিএফই অ্যাপে টাকা বিনিয়োগ করেছেন বলেও জানান তিনি। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমটিএফই অ্যাপে বিনিয়োগ করা আরেক যুবক বলেন, আমার পরিচিত এক ব্যক্তি ওই অ্যাপের প্রতিনিধি। তিনি আমাকে বলেছেন ৫০০ ডলার সমপরিমাণ টাকা অ্যাপে বিনিয়োগ করলে প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা লাভ পাওয়া যাবে। তার মাধ্যমে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে একটি একাউন্ট খোলা হয়েছে। সারাদিনের মধ্যে একবার ৩০ মিনিট ওই অ্যাপ খুলে বসে থাকতে হয়। সেখানে তাদের নিজ নিজ একাউন্টে কিছু পয়েন্ট ডলার হিসাবে জমা হয়। মাঝে মাঝে টাকাও তুলতে পারি। 

এমটিএফই অ্যাপের সিও পরিচয় দেওয়া সবুজ বলেন, এমটিএফই অ্যাপের অফিসও বলতে পারেন আবার আমার চেম্বারও বলতে পারেন। তার মত সারাদেশে এই অ্যাপের ৯ জন সিও রয়েছেন। কাউকে জোর করে ওই অ্যাপে টাকা বিনিয়োগ করতে বলা হয়না। একজন বেকার যুবক যদি একটি কর্ম পায় তাহলে আমাদের ভালো লাগে।

তবে যে কোন সময় অ্যাপ বন্ধ হয়ে গেলে বিনিয়োগ টাকার দায়ভার কে নেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব অ্যাপের সরকারি কোন অনুমোদন নেই। অ্যাপ বন্ধ হয়ে গেলে কেউ এর দায়ভার নেবে না। কিছু অ্যাপ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরাও বিভ্রান্তের মধ্যে পড়েছি। 

আরএমপি পুলিশের মিডিয়া মুখপাত্র রফিকুল আলম বলেন, এসব অ্যাপের কোন দেশে অনুমোদন নেই। এই অ্যাপের মাধ্যমে দেশের টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এসব বিষয় প্রতারণার শিকার হয়ে যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাওয়া দুটি অ্যাপের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। পুলিশ ১০-১২ জনকে গ্রেপ্তারও করেছে।

বিষয়টি আরএমপি সাইবার ক্রাইম ইউনিট খতিয়ে দেখছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

এএইচ


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি