ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৯ মে ২০২৪

আমার বন্ধু গোলাম সারওয়ার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:০৬, ২৭ আগস্ট ২০১৮ | আপডেট: ০৯:১৬, ২৭ আগস্ট ২০১৮

এই বন্ধুকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কোথা থেকে শুরু করব, ভেবে পাই না। সেই যে ১৯৬১ থেকে `৬৫-র সেসব দিন! বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। পুরনো কলাভবনের সেসব ক্লাসের দিন, যখন মেয়েরা একটি কমনরুমে এসে বসত ক্লাসের ফাঁকে। কেউ মানে কোনো ছেলে দেখা করতে চাইলে চিরকুট পাঠাত বাইরে থেকে। সেসব চিরকুট পাওয়ার পর মেয়েটি দেখা করতে যেত। আমাকে কয়েকটি চিরকুট পাঠিয়েছিল গোলাম সারওয়ার। সুদর্শন। মাথার চুল একটু কোঁকড়া। চোখ সবুজ। গায়ের রঙ ফর্সা। মুখে মিষ্টি হাসি। অলিভ ফর্সা রঙ। প্রথমদিকের চিরকুট ছিল এমন- আজ কি মধুসূদনের ক্লাস হবে? না হলে- তোমার নোট খাতাটা কি ধার দেবে? ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির তিন মাস পর বিয়ে হয়ে গেলে ভাবলাম, সারওয়ার আর কোনো চিরকুট পাঠাবে না। আমার আশঙ্কা মিথ্যা করে আবার চিরকুট এলো। সেই সবুজ চোখ, সেই হাসি হাসি মুখ।

ডেকেছো কেন?

আজাদীর মেয়েদের পাতা দেখতে হবে। তুমি দেখবে?

আমরা তো থাকি ঢাকায়। চিটাগাংয়ে কাগজ বেরোবে। তাহলে?

সব ডাকে যাবে। যারা লেখা পাঠাবে তাদেরগুলো একটু সংশোধন করে দেবে; ব্যস। ফিরে যেতে যেতে বলল, বেশ লাগছে তোমাকে।

খুশি হলাম। তার মানে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব এমন নয়, বিয়ে হয়ে গেলেই শেষ হয়ে যায়। ভয়ানক আনন্দিত হলাম। করিডোর ধরে আসতে আসতে নানা কবিতার চরণ ভেসে আসে আজকাল- আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায় আমার আঙ্গিনা দিয়া। এ ছাড়াও কে যেন মেয়েলি সুর নকল করে বলছে- এখন তবে আসি লক্ষ্মীটি।

ও এসব নয়। বলেছিলাম- আমাকে বাদ দিয়ে আর কাউকে সাহিত্যের পাতা দেখতে বলো না কেন?

আমি তোমার লেখা পড়েছি এখানে-ওখানে। ভালোই লেখ। এবার মেয়েদের পাতা দেখ। লেখা হলে আমাকে দেবে। আর অন্য লেখাগুলোও একটু সম্পাদনা করবে।

আমি রাজি হলাম খুশিতে। ও আমাকে এ কাজের যোগ্য মনে করেছে সেই জন্য খুশি, না অন্য কোনো কারণ, এখন বলা মুশকিল। এখন জানি, সে খুশির কারণ ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক গভীর নিবিড় বন্ধুত্বের। আঃ কী সুন্দর! গোলাম সারওয়ার আমার মনে বেশ একটু স্নিগ্ধ ছাপ রেখে চলে গেল। এর পর আরও চিরকুট পেতাম। লেখা দিতাম আর নিতাম। সবুজ চোখ, কোঁকড়া চুল আর অলিভে মাজা রঙ। ঠোঁটে সব সময় ধরে রাখে হাসি। ও আমাদের বাড়িতেও এসেছিল। বিয়ে হয়ে গেছে তখন আমার। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একটি বাংলো বাড়িতে থাকতাম

আমার স্বামী তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। আমার ছয় মাসের মেয়েটাকে নিয়ে বেশ একটু লোফালুফি করেছে।

তখনকার সেই বিশ্ববিদ্যালয়? মানে তখনকার সেই কলাভবন? অতুলনীয়। যেখানে কত বিদ্বান, বুদ্ধিমান সময় কাটিয়ে চলে গেছেন! বুদ্ধদেব বসুসহ আরও কতজন! আর স্যারদের ঘরের পেছনে, সবুজ মাঠ, পুকুরপাড়ে আমাদের নিবিড়, গভীর, সহাস্য, আনন্দময় আড্ডা। টিনের ছাদ দেওয়া ঘরে স্যার ক্লাস নেন। মুনীর স্যার ম্যাকবেথ এবং ওয়ার অ্যান্ড পিস পড়ান সেখানে। সেগুলো পড়তে হয়েছিল অনুবাদ সাহিত্য বুঝতে। আমরা কেউ মুনীর স্যারের ক্লাস মিস করিনি। তিনি ভুলে গেলেও আমরা তাঁকে ভুলতে দিইনি। কী অসাধারণ সে পড়ানো! একদিন লক্ষ্য করি, গোলাম সারওয়ার হাঁ করে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। লক্ষ্য করি আমরাও তাই। আমাদের ঘাসের মাঠ, পুকুরপাড়ের আড্ডায় আলোচনা হয় গোলাম সারওয়ারের চিত্রালীর গল্প `দুপুরে গোধূলী` নিয়ে। তখন মেয়েরা একটু হেসে বলে- ও কাকে পছন্দ করে রে?

ও খুব ভালো ছেলে। ও ওসব করে না। তারপর মেয়েরা ফিরে যায় অন্য গল্পে।

মেয়েরা ছেলেদের নাম দেয়। ভাবলাম, গোলাম সারওয়ারের নাম কি তখন থেকে `ভালো ছেলে` হয়ে গেল? কারণ হুমায়ূন খানকে বলা হতো বলবান। গোলাম কাদের সবুজ নামের ছেলেটির নাম চটপটি। জিয়া আনসারীর পরিপাটি সাজের জন্য জামাইবাবু। দিলিপ দত্তের নাম রেভারেন্ড। সে এখন সত্যিকার অর্থে রেভারেন্ড। এমনি সব নাম। কিন্তু মনে হয় না, ওর নাম তেমন করে বদলে দিয়েছিল কেউ। ওকে সবাই পুরো নামেই ডাকত। ফেরদৌসীর মন মাতানো গল্প, চমৎকার ক্যাম্পাস, প্রাণপ্রিয় স্যারদের বক্তৃতা। আরও সহপাঠী ও সহপাঠিনীর সঙ্গ। তাদের নানা গল্প। কেমন করে কেটে গেল সেসব সময়! এক সময় এই কাজ কেমন করে বন্ধ হয়ে গেল! আমার সাংবাদিকতা শেষ হলো। ও বোধ করি বেশ একটু জ্বরে ভুগছিল।

এর পর আমি দীর্ঘদিন বাইরে। মানে গ্রেট ব্রিটেনে। তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে গেলে ওখানেই একসময় থেকে যাই আমরা। যা হয়- আজ আসি, কাল আসি। তার পর আর আসা হয় না। তবে আসি মাঝে মাঝে বেড়াতে। ওর সঙ্গে দেখা হয় না। একবার ওর ইত্তেফাক অফিসে ফোন করে আমার আসার কথা বলি। বোধ করি সে ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার ২৭ বছর পরের। ও বলল, ও আমাদের বাড়িতে আসবে। আমাদের বাড়ি জিগাতলায়। বাড়ির নাম `সুদক্ষিণা`। ও এলো। অনেক কথা হলো। জানতে পারলাম, ওর স্ত্রীর নাম সালেহা। বেশ হাসাহাসি হলো। সারওয়ার ওর বাড়িতে আমাদের দাওয়াত দিল। বলেছি, আমি মাছ পছন্দ করি। ওর স্ত্রীকে ভালো লাগল। বললাম- মিতা, এত কিছু রান্না করেছেন আপনি? কোনো মাছই যে বাদ নেই!

মিতা হেসে বললেন- আমি যতক্ষণ রান্না করেছি সারওয়ার রান্নাঘরে চেয়ার নিয়ে বসে ছিল। ও প্রতিটি রান্না নিজে চেখে দেখেছে।

আমি অভিভূত। ওর বাড়ির নাম `রত্না`। মেয়ের নামে বাড়ির নাম। ও বলেছে- ভাইরা যেন বোনকে ভুলে না যায় তাই ও বাড়ির নাম রেখেছে রত্না। ওর বাড়িতে একটি চমৎকার বারান্দা আছে, যার কথা আগে বলেছি। একদিন বিকেলবেলায় ঝুম বৃষ্টিতে সেই বারান্দায় বসে গল্প করার ইচ্ছা মনে রেখে ভরপেটে চলে আসি। বলি- জীবনে আমি একসঙ্গে এত প্রকার মাছ খাইনি। আমার মনে হয়, আমি বরাবরই গোলাম সারওয়ারকে তুমি বলতাম। পরবর্তী সময়ে আমরা অনায়াসে একে অন্যকে তুমি বলতাম। সবকিছুই তখন সহজ।

এর পর এলো ওর যুগান্তরের সম্পাদনার কাল। আমি লন্ডন থেকে ওর ঠিকানায় লেখা পাঠাতাম। তখন সাহিত্য পাতা দেখত আলিম আজিজ নামে একজন তরুণ। ও একসময় ব্রিটেনে আসে পড়াশোনা করতে। ও বলেছিল- জানেন সালেহা আপা, সারওয়ার ভাই আপনার লেখা হাতে করে এনে আমাদের বলতেন- এ আমার সহপাঠিনী সালেহা চৌধুরীর লেখা। লেখা ঠিকমতো ছাপাবে। আপনার লেখা নিয়ে সারওয়ার ভাই গর্ব করতেন।

সারওয়ারকে নিয়ে আমার গর্বের শেষ ছিল না। আমার সহপাঠী আজ এত বড় একজন সম্পাদক! এখন ও সাংবাদিকতার জগতে কিংবদন্তিতুল্য। সুস্থ সাংবাদিকতার জগতে তাঁর নাম অবিস্মরণীয়। আমি অবাক হয়ে ভাবি সে কথা। শুরু করেছিলাম দু`জনে একসঙ্গে সম্পাদনার কাজ। কিন্তু আজ আমার বন্ধু সারওয়ার সম্পাদনার মধ্য গগনে। আমি হতে না পারি সম্পাদক, আমার বন্ধু হয়েছে।

আমি তো তখন ব্রিটেনে স্কুল শিক্ষক হয়ে ওঠার কাজে বড় বেশি ব্যস্ত। পড়াশোনা আর পড়ানো নিয়ে। সংসার, ছেলেমেয়ে আর বাড়ি কেনা নিয়ে মহাব্যস্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আমাকে চিঠির পর চিঠি লিখছে ফিরে যাওয়ার জন্য। আমার এক বছরের ছুটি পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানোর পরও আমি ফিরে যেতে পারিনি। কাগজ হাতে পেলেই ওর সম্পাদকীয় পড়ি। ভালো লাগে। বোঝা যায়, ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়েছে। ও সাধু বাংলায় লিখত। যুগান্তরে প্রতিদিন বাংলাদেশের একটি ভালো খবর ছাপা হতো- `সুপ্রভাত বাংলাদেশ`। বেশ একটু পজিটিভ চিন্তা। বলা যায়, এই ভাবনা অনন্যসাধারণ। ওর লেখা বইগুলোও বেশ উন্নত মানের। `আমার যত কথা` বেশ লেগেছে আমার। তবে ওটা `আমার যত কথা` না হয়ে `আমার কিছু কথা` হলে ভালো হতো। ওর যত কথায় আমরা কেউ নেই, তা হতে পারে না। একবার হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন- জানতাম না ওর বাংলা লেখা এত ভালো। আমিও সে কথা বলি।

১৪২১ সনকে ও যেভাবে স্বাগত জানিয়েছে- একজন সাহিত্যিকই পারেন এমন করে লিখতে। `অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।` আমি কাগজটি কেটে রেখে দিয়েছি। একটু সাহিত্য একটু ইতিহাস মিলে চমৎকার হয়েছিল সে লেখা। ওর লেখা অনেক কাটিং আমার সংগ্রহে আছে। আমাকে যখন কলাম লিখতে বলেছিল, আমি বলেছিলাম- ওইসব রাজনৈতিক কলাম কি আমার হবে? -তা কেন? তুমি লিখবে তুমি যা দেখছ। ইউরোপের চিঠি দেবে আমাদের। এইভাবে হাত ধরে কলাম লিখতে আমাকেও শিখিয়েছিল একদিন। আমি তো বলি যুগান্তর, সমকাল- সব তোমার বেবি। বেশ কিছুদিন আগে বন্ধুত্ব নিয়ে কিছু ইংরেজি কোটেশন পড়েছিলাম। একটি কোটেশন মনে পড়ছে- If you have just one good friend you got more than your fair share. সারওয়ার বন্ধু হলে এমন কথা বলা যায় বৈকি।

তারপর? কেমন করে চলে গেল ও! হঠাৎ। হৃদয় চূর্ণ। চোখ মাঝে মাঝে কেন যে ভিজে যায় বুঝি না। নক্ষত্রের বন্ধু হয়ে অনাদিকালের দেশে। বিশ্বাস করতে পারি না। যে আমাকে হাত ধরে এনেছিল কলাম লেখার জগতে, সে নেই। দু`জনে কতবার ঢাকা ক্লাবে গেছি! কিছু বন্ধুত্বের কথা, হাসাহাসি। সঙ্গে খাবার বেঁধে দিয়েছে। বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। না, সারওয়ার একজন নারীকে একা পেয়ে আলো-অন্ধকারের রহস্যে চারপাশের সোমরসের জগতে কোনো এক আদি রসালো গল্প ফেঁদে বসেনি। এখানেই ওর বৈশিষ্ট্য। যেন ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে একটু ভিজে সেকালের আর্ট ভবন থেকে বেরিয়ে আসছি আমরা।

ব্রিটেন প্রবাসী কথাসাহিত্যিক

(সমকাল থেকে সংগৃহীত)

একে//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি