ইরানে গোপন নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল মোসাদ
প্রকাশিত : ১১:৪৪, ২২ জুন ২০২৫

ইরানের ওপর ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার সূচনা আকাশপথ ধরে নয়, এর শুরুটা হয়েছিল স্থলপথ ধরে। এই হামলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইসরায়েল। প্রস্তুতির ভিত্তি ছিল গভীর গোয়েন্দা তথ্য ও ইরানে অপারেশনাল অনুপ্রবেশ।
ইরানের মাটিতে লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করা এবং এই অভিযানকে পরিচালনা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত অসংখ্য রিপোর্ট এবং কয়েকজন ইসরায়েলি কর্মকর্তার মন্তব্য থেকে এই বিষয়টা স্পষ্ট যে 'অ্যান্টি সাবমেরিন সিস্টেম' (সাবমেরিন বিধ্বংসী ব্যবস্থা), ক্ষেপণাস্ত্রের ভান্ডারকে নিশানা করার পাশাপাশি ইরানের কমান্ড সেন্টার এবং সে দেশের অভ্যন্তরে নির্বাচিত ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে একযোগে এবং অত্যন্ত নিখুঁত পদ্ধতিতে হামলা চালানো হয়েছিল।
ইসরায়েল বহুদিন ধরেই ইরানে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গোয়েন্দা অনুপ্রবেশ ও স্থলভিত্তিক নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে হামলার ভিত গড়ে তোলে তারা।
ইরানের অভ্যন্তরে অস্ত্র চোরাচালান, সমাবেশ ও অস্ত্র উৎপাদন
ইসরায়েলি ও পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিষয়টা শুধু ইরানের সংবেদনশীল তথ্য অব্দি পৌঁছানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এই প্রতিবেদনগুলো এও ইঙ্গিত করে যে ইরানের মাটিতে আক্রমণাত্মক অস্ত্র তৈরি ও মোতায়েনের জন্য একটা সংগঠিত ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলেছিল ইসরায়েল।
স্থানীয় এজেন্টদের নেটওয়ার্ক, তাদের জন্য কভার (এজেন্টদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য)-এর জন্য ব্যবস্থা করা, পরিবহন ব্যবস্থা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই গোপন কর্মকাণ্ড দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে বলে অভিযোগ।
আর এই প্রস্তুতির ভিত্তিতেই সাম্প্রতিক হামলার ভিত্তি স্থাপন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সামরিক বিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা 'দ্য ওয়ার জোন' এবং অন্যান্য সূত্রের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে ইরাকের মধ্য দিয়ে যাওয়া ট্রাক, বাণিজ্যিক কন্টেনার এবং যাত্রী স্যুটকেসের মধ্যে বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে রেখে ইরানে অল্প অল্প করে সংবেদনশীল ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র সরঞ্জামের চোরাচালান করেছে ইসরায়েল।
পরে এসব যন্ত্রাংশ থ্রিডি প্রিন্টারসহ গোপন কর্মশালায় একত্র করে আক্রমণাত্মক অস্ত্র বানানো হয়। তেহরানে তিনতলা একটি ভবনে আত্মঘাতী ড্রোন তৈরির ঘাঁটির খোঁজ পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছে ইরানি বার্তা সংস্থা। সেখানে বিপুল পরিমাণ ড্রোন যন্ত্রাংশ, থ্রিডি প্রিন্টার ও নিয়ন্ত্রণ সরঞ্জাম ছিল।
ইরানি পুলিশের তথ্য মতে, গত ১৬ জুন তেহরানের দুটি পৃথক অভিযানে মোসাদ-সংশ্লিষ্ট দুই এজেন্ট গ্রেপ্তার হয়। তাদের কাছ থেকে ২০০ কেজির বেশি বিস্ফোরক, ২৩টি ড্রোন যন্ত্রাংশ, লঞ্চার ও একটি গাড়ি উদ্ধার করা হয়। ইসফাহানেও বিপুলসংখ্যক মাইক্রো ড্রোন তৈরির উপকরণ ধরা পড়ে।
রিমোট কন্ট্রোল ক্ষেপণাস্ত্র ও স্মার্ট অস্ত্র
ইরানে হামলার একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল স্মার্ট, রিমোট কন্ট্রোলড অস্ত্রের ব্যবহার। ইরান দাবি করেছে, ইসরায়েলের ব্যবহৃত স্পাইক মিসাইল লঞ্চার ইন্টারনেট-অটোমেশন ও স্যাটেলাইট গাইডেন্স সিস্টেমে নিয়ন্ত্রিত ছিল।
এসব অস্ত্র মোসাদের এজেন্টরা পরিচালনা করছিল বলে অভিযোগ। এ ধরনের অস্ত্র ২০২০ সালেও ব্যবহার করা হয়েছিল, যখন রিমোট কন্ট্রোল অস্ত্রের সাহায্যে এক ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছিল।
আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করা
বিশ্লেষকদের মতে, হামলার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করা। ছোট আকারের আত্মঘাতী ড্রোন, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং ক্ষেপণাস্ত্র একযোগে ব্যবহার করে রাডার ও প্রতিরক্ষা প্ল্যাটফর্মগুলো অকেজো করে দেওয়া হয়। ইসরায়েলি অভিযানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ইরানের সামরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাঠামোকে দুর্বল করা। উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, বিশেষত ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজমি এবং তাঁর ডেপুটিকে সরাসরি নিশানা করা হয়। হামলার পরই ইরান সরকারের পক্ষ থেকে কর্মকর্তাদের স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়, যা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়।
নিরাপত্তা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সুপরিকল্পিত অভিযান শুধু সামরিক ঘাঁটিতেই নয়, ইরানের গোয়েন্দা ও সাইবার নিরাপত্তার ওপরেও ব্যাপক আঘাত হেনেছে। জনসাধারণকেও ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার কমানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যদিও ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে হামলার দায় স্বীকার করেনি, তবুও সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, গোয়েন্দা তথ্য ও প্রকাশিত রিপোর্টগুলো এটিই নির্দেশ করে যে, ইরানে হামলার পূর্বপ্রস্তুতি বহু বছর ধরে গোপনে চলছিল। এটি ছিল একটি প্রযুক্তিনির্ভর, উচ্চমাত্রার গোয়েন্দা অভিযানের বাস্তবায়ন—যার মাধ্যমে ইরানের অভ্যন্তরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
টার্গেটেড কিলিং এবং কমান্ড সিস্টেমের ক্ষতি
ইসরাইলের অভিযানের আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তারা ইরানের সামরিক বাহিনী ও রেভল্যুশনারি গার্ডের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যবস্থাকে দুর্বল করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিত্বদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নিশানা করেছে।
প্রতিবেদনে বলে হয়েছে মোসাদ ও তার মিত্র দলগুলো গোপন তথ্য ও স্মার্ট অস্ত্রের সাহায্যে ইরানের কমান্ড সিস্টেম ভাঙার এবং 'চেন অফ কমান্ড'-এ বাধা তৈরির চেষ্টা করে। ইরানের সামরিক প্রস্তুতিকেও ধীরে করে দেয় তারা।
অভিযানের শুরুতেই চালানো কয়েকটা হামলায় সামরিক ঘাঁটি বা ক্ষেপণাস্ত্র প্ল্যাটফর্মকে নিশানা করা হয়নি। হামলা চালানো হয়েছিল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাড়িতে বা অফিসে।
গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কমান্ডদের নিশানা
প্রাপ্ত প্রমাণে দেখা গিয়েছে, ইসরায়েলের গোয়েন্দা প্রস্তুতি শুধু ইরানে হামলা চালানোর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত চলেনি, তারপরেও জারি থেকেছে। ইরানে হামলা সময় সমান্তরালভাবে সে দেশের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদেরও নিশানা করা হয়।
রেভল্যুশনারি গার্ডের গোয়েন্দা শাখার প্রধান মোহাম্মদ কাজমি ও তার ডেপুটিকে হামলার তৃতীয় দিনে নিশানা করা হয়। একইসঙ্গে শুক্রবার এক কমান্ডারের মৃত্যুর পর তার জায়গায় নিযুক্ত হওয়া এক কর্মকর্তাকেও হত্যা করা হয়। ওই পদে নিয়োগের পর মাত্র চারদিন হয়েছিল।
আমেরিকান থিংক ট্যাংক 'হাডসন ইনস্টিটিউট'-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলের এই পুরো কৌশল বহু বছরের প্রস্তুতির ফসল, যার মধ্যে রয়েছে ক্রমাগত তথ্য সংগ্রহ, রিয়েল-টাইম মনিটরিং এবং নির্ধারিত লক্ষ্যের একেবারে ভেতরে নির্ভুলভাবে পৌঁছানো।
সূত্র : বিবিসি
এএইচ
আরও পড়ুন