ঢাকা, সোমবার   ২০ মে ২০২৪

চারিদিকে রোহিঙ্গাদের আর্তনাদ : ক্যাম্পেও মিলছে না ঠাঁই, নেই খাবার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২২:৩৯, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ২০:১০, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতায় সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা আসায় ক্যাম্পগুলোয় স্থান সংকুলান হচ্ছে না। ফলে ক্যাম্পে ঠাঁই মিলছে না অধিকাংশ শরণার্থীর। তারা রাস্তাঘাট,দোকানপাটসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা এসব রোহিঙ্গা প্রয়োজনীয় ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা পাচ্ছেন না। খাবার ও পানির তীব্র সঙ্কটে খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করছেন তারা। এরই মধ্যে আগামীকাল থেকে খুলছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা। যারা ইতোপূর্বে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন তারা কোথায় যাবেন এ প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।  

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৫ আগস্ট নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে গত ১০ দিনে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের প্রতিবেদনে ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকার কথা বললেও বাস্তবে এর সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রের দাবি।

এর মধ্যে গত রোববার (০৩ সেপ্টেম্বর) এক রাতের ব্যবধানেই টেকনাফ হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গা। যদিও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর কর্মকর্তা ভিভিয়েন ট্যান বলছেন, এক রাতের ব্যবধানে রোববার নতুন করে অন্তত ১৩ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে।

রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের খোঁজে পাহাড়-সমতল ও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। অচিন এলাকায় যে যেখানে পারছেন সেখানেই মাথা গোঁজার ঠাঁই নিচ্ছেন। ফলে উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় নতুন করে গড়ে উঠছে ঝুপড়ি ঘর।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ঈদের দিন ঘুমধুম সীমান্তে জাফর-আয়েশা দম্পতি মিয়ানমার সেনাদের গুলিতে খুন হওয়ার পরই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। প্রতিটি সীমান্ত দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকছে। শিশু-বৃদ্ধদের কোলে-কাঁধে করে নিয়ে আসছে তারা। যেসব সীমান্তে বিজিবির কড়া অবস্থান রয়েছে, সেখানকার জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছে রোহিঙ্গারা। রাতে কিংবা বৃষ্টিতে যে যার সুযোগ মতো বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। গত কয়েকদিনে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এর মধ্যে রোববার রাতে ঢুকেছে ২০ হাজারেরও বেশি।

সীমান্ত এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত সময়ের চেয়ে এবার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে অনেক বেশি। উখিয়া-টেকনাফ উপজেলার বন বিভাগের জায়গা দখল করে আরও ৩টি অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। ফলে সীমান্ত এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী ঢালার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। নতুন করে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এরা সহায়-সম্বল রেখে প্রাণ বাঁচাতে এদেশে আশ্রয় নিলেও বাঁচার তাগিতে আগের রোহিঙ্গাদের মতো এরাও অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মোজাফ্ফর আহাম্মদ বলেন, আমার সীমান্ত দিয়ে কোনো রোহিঙ্গা প্রবেশ করতে পারেনি। যারা এসেছে ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত এলাকা দিয়ে ঢুকেছে।

কুতুপালং ও বালুখালী এবং লেদা রোহিঙ্গা বস্তি নিয়ন্ত্রণকারী মাঝিদের দাবি, তাদের একেক বস্তিতে নতুন করে ৫০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। নতুন করে আরও কয়েকটি বস্তি গড়ে তোলা হয়েছে। সব মিলে নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দেড় লাখের বেশি।

কুতুবপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের মাঝি আবু ছিদ্দিক  বলেন, আমাদের ক্যাম্পে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত অর্ধ লাখেরও বেশি নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশে আশ্রয় নিয়েছে। বলতে গেলে এর সংখ্যা ৬০-৭০ হাজারের কম নয়। পুরনো যে দুটো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির- কুতুপালং এবং নয়াপাড়া- তাতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই।

বালুখালী ক্যাম্পের মাঝি ইলিয়াছ ও ছৈয়দ নূর জানান, তাদের ক্যাম্প ও আশপাশ এলাকায় নতুন করে অর্ধলাখ রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। যে যেভাবে পারছে, যেখানে পাচ্ছে সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে। যখন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে এসব ক্যাম্পে আসে তখন তাদের তাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ থাকে না বলেও জানান তারা।

নতুন করে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে স্বীকার করে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, গত কয়েকদিন আশঙ্কাজনকহারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকেছে। ঠিক কত সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এর সংখ্যা এক লাখের বেশি।

আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ঢুকেছে। তবে দেড় লাখ হবে কিনা তা এখনও নিশ্চিত না। যেভাবে রোহিঙ্গারা স্রোতের মতো বাংলাদেশে ঢুকছে এর সংখ্যা দ্বিগুণ হতে বেশি সময় লাগবে না বলেও জানান তিনি।

এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা-নির্যাতন ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকার মুখে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে জরুরি খাদ্য সরবরাহ কর্মসূচি স্থগিত করেছে জাতিসংঘ।

২০১২ সাল থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহযোগিতা দিয়ে আসছিল জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। এতে আড়াই লাখ মানুষের খাদ্যের সংস্থান হতো। কিন্তু এ কর্মসূচি স্থগিত করায় তাদের খাদ্য নিরাপত্তায় চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হলো।

গত শনিবার ডব্লিউএফপির এক বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় অভ্যন্তরীণভাবে গৃহহীন দুই লাখ ৫০ হাজার এবং অন্যান্য অতিদরিদ্র মানুষের মধ্যে যে খাবার সাহায্য দেওয়া হতো, তা স্থগিত করা হলো। এদের মধ্যে রাখাইন রাজ্যেই বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা এক লাখ ২০ হাজার মানুষ ডব্লিউএফপির খাবারের ওপরই নির্ভর করত, যাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা।

যারা জীবন বাঁচিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, তাদের অবস্থাও করুণ। অনেকে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় পেলেও খাবারের তীব্র সংকটের মধ্যে রয়েছেন। অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অনেক রোহিঙ্গা পরিবার মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে উপকূলের পাশে বন-জঙ্গল সাফ করে বাঁশ-প্লাস্টিক দিয়ে ছাউনি তৈরির চেষ্টা করছে।

রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে পরিবার নিয়ে চার দিন আগে বাংলাদেশে এসেছেন যুবক মোহাম্মদ হোসাইন। তিনি বলেন,কিছু বেসরকারি সংস্থার লোকজন এখানে এসে আমাদের দেখে গেছে। কিন্তু কোনো খাবার আমাদের নেই। অনেক গর্ভবতী নারী খোলা আকাশের নিচে রাস্তার পাশে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। অসুস্থ শিশুদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাও এখানে নেই।

গত ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইন রাজ্যে একসঙ্গে ২৪টি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। ‘বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের’ সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এই হামলার দায় স্বীকার করে। এ ঘটনার পর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। সেখান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দাবি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নির্বিচারে গ্রামের পর গ্রামে হামলা নির্যাতন চালাচ্ছে। নারীদের ধর্ষণ করছে। গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে।

মিয়ানমারের সেনাপ্রধান গত ১ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমকে জানান, মিয়ানমারে সহিংসতা শুরুর পর গত এক সপ্তাহে ৪০০ জন নিহত হয়েছেন।

আরকে/ডব্লিউএন


Ekushey Television Ltd.





© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি