ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

টেলিভিশনের সংবাদ নজরদারির সিদ্ধান্তে বিরূপ প্রতিক্রিয়া

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২২:৩৫, ২৬ মার্চ ২০২০

সরকারি বিজ্ঞপ্তি

সরকারি বিজ্ঞপ্তি

করোনা ভাইরাস নিয়ে অপপ্রচার ও গুজব বন্ধে ১৫ জন কর্মকর্তাকে দেশের ৩০টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ মনিটরিংয়ের (তদারকি) দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। এ বিষয়টিতে বিস্ময় প্রকাশ করে সমালোচনা করছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকসহ বিশিষ্টজনেরা। বিষয়টি নিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসিও।

গত মঙ্গলবার তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ জারি করা হলেও তা প্রকাশ্যে আসে বৃহস্পতিবার। এরপরই দেশব্যাপী শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। 

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা তার ফেসবুক পাতায় মন্ত্রণালয়ের ঐ আদেশটি সংযুক্ত করে লেখেন, ‘আকামের লোকজনের কাম খুঁজে পাওয়া কত সহজ!!!’ তার এ পোস্টে অনেকে সিদ্ধান্তটির সামালোচনা করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর নিজ ফেসবুক পাতায় লেখেন, ‘বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো গুজব রটাচ্ছে কী না তা দেখভাল করতে সরকার একটি মনিটরিং সেল গঠন করেছে বলে খবর পা্ওয়া গেলো? যেই সময়ে সরকারের করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ব্যাপারে জনসাধারনকে সচেতন করার উদ্যোগ নেয়া দরকার, চিকিৎসা কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কী না সেটি মনিটরিং এর উদ্যোগ গ্রহন দরকার, ভাইরাসের ছড়িয়ে পরা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ পালিত হচ্ছে কী না সেগুলো দেখা দরকার, সেগুলো না করে সরকার ছরি ঘুরানোর দিকে কেন মনোযোগি হয়ে পরলো?

ডাক্তারদের ব্যাপারে সরকারের কয়েকটি নির্দেশ, যদিও সেগুলো পরে প্রত্যাহার করা হয়েছে, প্রমান করেছে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের চেয়েও সরকারের প্রশাসন মাতাব্বরির দিকে বেশি মনোযোগি। সঠিক তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা না হলেই গুজব ছড়ায়, মনিটরিং করে গুজব বন্ধ করা যায় না- এটা সরকারকে বুঝতে হবে। আর পত্রিকা, টেলিভিশন গুজব ছড়ায় না। ডাক্তারদের পিপিই নিয়ে কতো কথা হচ্ছে- কই, সরকারের কোনো সংস্থা, এমনকি স্বাস্থ্যমন্ত্রনালয়ও তো খোলামেলো করে বলেনি- তাদের আসলে কি পরিমান পিপিই আছে, কারা কারা পিপিই ব্যবহার করতে পারছে, কারা পারছে না, না পারলে কেনো পারছে না। সরকার এই বিষয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করছে না কেন?

সরকারকে বলি, বাইরের পৃথিবীর দিকে তাকান। পৃথিবীর কঠিনতম সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের, তথ্য প্রবাহ সচল রাখার দায়িত্ব পালনের জন্য কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের প্রতি, মিডিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। মিডিয়ার জন্য আলাদা সহায়তা কর্মসূচী ঘেঅসনা করেছে। বাংলাদেশের সরকার সহায়তা তো দুরের কথা ধন্যবাদটুকু পর্যন্ত দেয়নি। বরং সাংবাদিকদের আনুষ্টানিকভাবে অপবাদ দিচ্ছেন। কি লজ্জার কথা!

অদক্ষ, জনবিচ্ছিন্ন আমলাতন্ত্র দিয়ে করোনা ভয়াবহ ছোবল থেকে দেশকে বাঁচানো যাবে না, নিজেরা্ও বাঁচবেন না। মনিটরিং করে গুজভ বন্ধ করা যায় না। গুজব বন্ধে দরকার হয় তথ্য প্রবাহ অবাধ করে দেয়া। কিন্তু সরকারের পদক্ষেপ দেখে মনে হচ্ছে তারা আসলে ধমক দিয়ে, ভয় দেখিয়ে তথ্য প্রবাহ বন্ধ করে দিতে চায়। ইলে বেসরকারি টেলিভিশনের ‘গুজব বন্ধে’ সরকারের লাফালাফি করার দরকার হতো না।’

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব শাবান মাহমুদ লেখেন, ‘যদি টেলিভিশন কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়া গুজবের কারণ হয় অভিযোগ প্রমান করুন, প্রয়োজনে সেই টেলিভিশনের লাইসেন্স বাতিল করুন কিন্তু খবরদারির নামে এভাবে টেলিভিশন গণমাধ্যমকে বিতর্কিত করবেন না । যারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিরুদ্ধে গুজব রটায়, যাদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা রয়েছে তাদের গ্রেফতারের খবর নেই অথচ টেলিভিশন মিডিয়াকে সন্দেহের তালিকায়...বিএফইউজে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে ...’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী সরকারের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠান অদক্ষ লোকবল দিয়েই পরিচালিত হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। 

তিনি নিজ ফেইসবুক পাতায় লেখিছেন, ‘করোনা নিয়ে টিভিতে অপপ্রচার মনিটরিংয়ে ১৫ কর্মকর্তা", "চিকিৎসকদের জন্য জারি আদেশ বাতিল, সচিব বলছেন মূর্খতা।" বাংলাদেশের কিছু মন্ত্রণালয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান কতটা অদক্ষ আর অযোগ্য লোকবল দিয়ে চলছে তার বড় প্রমাণ গণমাধ্যমের এই দুটি সংবাদ শিরোনাম। একটা মন্ত্রণালয় যার কারবার তথ্য নিয়ে সেটি জানেই না ফেক নিউজ কী, গুজব কী, তথ্য ও সংবাদের পার্থক্য কোথায়, কে তথ্য নিয়ে কারবার করে আর কে তথ্যের বেসাতি করে!! একটি তথ্য মন্ত্রণালয় ও সরকার প্রধানের প্রেস উইং বা বিভাগ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কীভাবে সাহায্য করতে পারে তা শেখার জন্য প্রতিদিন ইউকে, ইউএসএ ও কানাডার সরকার প্রধানের ব্রিফিংগুলো দেখা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এখন ইংল্যান্ডের তথ্য মন্ত্রণালয় এবং ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের প্রেস উইংয়ের কাজ হলো সরকার যে তথ্যগুলো জনগণকে দিতে চায় তা কতটা সহজ ও সাবলীল ভাষায় পৌঁছানো যায় এবং কোন উপায়ে পৌঁছালে তা দ্রুত ও সহজে জনগণের কাছে পৌঁছবে তা নিয়ে কাজ করা। গত দুই দিন ধরে ফেসবুকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে আলোচনা চলছে। সাধারণভাবে বলা যায়, ইউএসএ, ইউকে ও কানাডা ছাড়া অন্য দেশগুলো করোনা দুর্যোগের সময় যে ধরনের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য মানুষের মধ্যে কতটা আপীল রাখতে পেরেছে? জনবক্তব্য আর রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে বিরাট ফারাক। এই দূরত্ব না বুঝলে সরকারের অনেক ভাল ভাল কাজ মানুষের মনে জায়গা পায় না। জনবক্তব্য কখনই পিরামিড কাঠামোতে হতে পারে না। পিরামিড কাঠামো বুঝার জন্য 'টপলাইন জ্ঞান' থাকাটা জরুরি। ঘরে থাকার অনুরোধ, গরীবদের জন্য এত কোটি টাকার প্যাকেজ আর স্বাস্থ্য খাতের উদ্যোগের তথ্য পেতে যদি ৫ মিনিট লেগে যায় তাহলে তাতে মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবেই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো শুনে দেখেন তিনি কখনই অতীত দিয়ে বক্তব্য শুরু করতেন না, তিনি অতীতকে বর্তমানের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে তুলে ধরতেন।তার বক্তৃতাগুলো জনপ্রিয়তার অন্যতম বড় কারণ এটি। একজন প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে 'সঙ্গনিরোধ'সহ প্রচুর দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। একজন বস্তির নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত মানুষের কাছে এ শব্দের অর্থ কে পৌঁছে দিবে? বরিস জনসন বা ট্রাম্প কেউই কোয়ারেন্টন শব্দ ব্যবহার করে না; তারা সোজাসাপ্টা বলেন, ঘরে থাকুন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তৈরির জন্য বড় টিম থাকাটাই স্বাভাবিক। এদের বেতন-ভাতাও কম না। কিন্তু এদের উপযোগিতাটা কী? বরিস জনসনের প্রেস উইং একটি কাজ নিয়মিত এখন করছে, তা হলো সাংবাদিকরা মানুষের কাছ থেকে যেসব প্রশ্ন পাচ্ছে সেগুলোর একটি অগ্রাধিকারমূলক তালিকা তৈরি করে সরকারের কাছে তুলে ধরা। মি. জনসন প্রতিদিন ব্রিফিংয়ে সে মোতাবেক প্রস্তুতি নিয়ে আসেন।

সরকারের ৮ জন উপসচিব যারা মাসে ৮০-৯০ হাজার বেতন পান তাদের কাজ হবে টেলিভিশনে গুজব ছড়াচ্ছে কীনা তা নিরীক্ষা করা!! বিশ্বব্যাপী গবেষণাতে দেখা গেছে, স্বীকৃত গণমাধ্যম বিশেষ করে রেডিও-টিভি-পত্রিকায় ফেক নিউজের হার ১ শতাংশেরও কম। এ হার বেশি অনলাইনে!!! সবচেয়ে বেশি সামাজিক মাধ্যমে। কোন গণমাধ্যম যদি ভুল তথ্য দেয় তাহলে তাকে সরাসরি জানিয়ে দেয়া হয় ঠিক তথ্যটি কী। একজন প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের দায়িত্ববান লোক যখন সংবাদ সম্মেলনে বলেন অমুক সংবাদ প্রতিষ্ঠান ভুয়া নিউজ করেছে, আজকের ভাইরাল যুগে ওই প্রতিষ্ঠানের ত্রাহি অবস্থা হতে দুই মিনিট লাগে না!! এর জন্য ১৫ উপসচিবের দরকার পড়ে না।

আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কথা না বলাই শ্রেয়!!! এই মন্ত্রণালয়ে আদৌ চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে পাশ করা কেউ আছেন কীনা সে বিষয়ে সন্দেহ করার মত যথেষ্ট কারণ আছে নিদেনপক্ষে এই মন্ত্রণালেয়র সর্বোচ্চ ব্যক্তিবর্গের গত কয়েকদিনের বক্তব্য আর কর্মকাণ্ডে।

করোনা একটি মহামারী। কোনো দেশের পক্ষেই এটি সামাল দেয়া সম্ভব যে নয় সেটি প্রমাণিত হয়ে গেছে। কিন্তু লড়তে হবে সবাইকে মিলে। দেখুন, যে দেশগুলোর সরকার তার স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা অবলীলায় দেশবাসীকে জানিয়েছে সেখানে দেশের মানুষ এগিয়ে আসছে স্বাস্থ্য খাতকে সাহায্য করার জন্য। এত ভেন্টিলেশন, আইসিইউ কোনো দেশেই থাকা সম্ভব না। সে তথ্য গোপন করার কিছু নেই। যখন মানুষ জানবে রিঅ্যাক্টিভ ব্যবস্থাগুলো খুব দুর্বল, তখন তারা এমনিতেই ঘরে ঢুকবে। তথ্য লুকাতে হলে মিথ্যা তথ্য দিতে হয়। আর একটা জনমিথ্যা ষোল কোটি মানুষের ক্ষতি করতে পারে।’

একাত্তর টেলিভিশনের বার্তা প্রধান শাকিল আহমেদ লেখেন, ‘করোনা মোকাবেলায় দেশের সম্প্রচার সাংবাদিকেররা যখন জীবন ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন তখন টেলিভিশনে গুজব খোঁজা কমিটি বিশ্মকয় ও অনভিপ্রেত ও হতাশাজনক।’ 

দৈনিক সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি রাশেদ মেহেদী, ‘পেটানোর অধিকার কোন আইন দিয়েছে?.. খবরে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ মাস্ক পড়ে কাজে বের হওয়া একাকী পথিককে দেখামাত্র পেটাচ্ছে, কান ধরে ওঠ বস করাচ্ছে.... কোন স্বাধীন দেশের পুলিশ এভাবে নাগরিকদের অসম্মান করতে পারে...? আগে জিজ্ঞেস করুন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে তিনি কেন বের হয়েছেন, জরুরী প্রয়োজনে বের হওয়ার কথা তোর সরকারি ঘোষণাতেই আছে ...যদি অপ্রয়োজনীয় কাজে বের হয় তাকে বাসায় ফিরে যেতে বলুন, আইন অমান্য করলে গ্রেফতারও করতে পারেন....কিন্তু গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার পুলিশকে কোন আইন দিয়েছে? যে কোন ছুতোয় মানুষের গায়ে হাত তোলাটা পুলিশিং নয়, অসভ্যতা.....

এমএস/এনএস


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি