ঢাকা, সোমবার   ০৬ মে ২০২৪

মোহামেডান-আবাহনী লড়াইয়ে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান কে এই প্রনব?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:০৩, ২৬ এপ্রিল ২০২০

দেশের ক্রীড়াঙ্গণে মোহামেডান-আবাহনীর লড়াইয়ের কথা নতুন করে কিছু বলার নেই। বর্তমানে তেমনটা উত্তেজনা না ছড়ালেও এর শুরুর দিকের গল্পগুলো ছিল রোমাঞ্চকর ও উত্তেজনায়পূর্ণ। এমনকি, চলতি দশকেও দেখা গেছে সে লড়াই। যা গোটা দেশের ক্রীড়াপ্রেমিদের দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছিল। 

মোহামেডান-আবাহনীর লড়াইয়ে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা মেলে একজন ভারতীয় বাঙালির হাত ধরে। যা অনেকেরই অজানা। জানা নেই তার পরিচয়।

অনেকে বলতে বলতে পারেন দেশের ক্রিকেট আর ঢাকাই ক্লাব ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের নামধাম জানার পর আবার আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের নাম জেনে কী হবে?

হ্যাঁ! এখনকার প্রেক্ষাপটে যে কেউ এমন প্রশ্ন করতেই পারেন। কারণ এখন আর ঢাকার ক্লাব ক্রীড়াঙ্গন মোহামেডান-আবাহনী কেন্দ্রিক নয়। আবাহনী কক্ষপথে থাকলেও মোহামেডান পিছিয়ে পড়েছে অনেকখানি। কিন্তু একটা সময় ছিল, যে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ মানেই সর্বোচ্চ আকর্ষণ। এ দুই দলই ছিল ‘সুপার পাওয়ার।’

ফুটবল-হকির সাতে পাল্লা দিয়ে মোহামেডান-আবাহনী ক্রিকেট লড়াই শুরু হয় ১৯৭৪-৭৫ মৌসুম থেকে। তারপর সময়ের সাতে তাল মিলিয়ে উভয়ে সাফল্য পেয়েছে। প্রতিবার না হলেও বেশিরভাগ বছরেই লিগ শিরোপা আবাহনী-মোহামেডানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।

শুরুতে ভিক্টোরিয়া, পরে আজাদ বয়েজ, বিমান, সুর্যতরুণ, রুপালী ব্যাংক, ব্রাদার্স, কলাবাগান আর জিএমসিসি'র গায়ে বড় দলের তকমা লাগলেও সত্তর দশক থেকে এই শতাব্দীর প্রথমভাগ (২০০৯-২০১০) পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় আবাহনী বা মোহামেডানই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। 

সত্তর দশকের শেষ দিকে এসে সে লড়াই রুপ নেয় শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে। আশি-নব্বইয়ের দশকে লিগ, দামাল স্মৃতি সামার, বিজয় দিবস, শহীদ দিবসসহ নানা ক্লাব টুর্নামেন্টের বেশিরভাগেরই ফাইনালিস্ট হয় মোহামেডান আর আবাহনী। আর সে কারণেই আকাশী-হলুদ আর সাদাকালোর খেলা রুপান্তরিত হয় মর্যাদার লড়াইয়ে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই দলের পাশাপাশি শীর্ষস্থানের ধরে রাখার লড়াইয়ে অনেকেই চেষ্টা করেছেন। রকিবুল হাসান, মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম, মাইনুল হক মাইনু, আহমেদ ইকবাল বাচ্চুর কথা সবারই মনে থাকার কথা। 

সবার ভাবনা তাদের কেউই হবেন হয়তো আবাহনীর বিপক্ষে মোহামেডানের প্রথম শতরানকারী ব্যাটসম্যান? আর আবাহনী সমর্থকদের বড় অংশের ধারণা নিশ্চয়ই আলিউল ইসলাম, রিজভি, কালিচরন বাবু, ওমর খালেদ রুমি না হয় রফিুকুল আলমের কেউই হবেন মোহামেডানের বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান।

কিন্তু ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। কেননা, আবাহনীর প্রথম অধিনায়ক আলিউল ইসলামের সামনে ছিল সুবর্ণ সুযোগ আসলেও তিনি তা কাজে লাগাতে পারেননি। বাকিরা সবাই পরবর্তীতে একাধিক সেঞ্চুরি করেছেন। আসলে মোহামেডান-আবাহনী লড়াইয়ে প্রথম সেঞ্চুরি ছিল এক ভারতীয় বাঙালি তরুণের। নাম প্রনব রায়।  

উপরের সবাইকে টপকে সাদাকালো আর আকাশী হলুদ লড়াইয়ের প্রথম শতরানের কৃতিত্ব গড়েন এই ভারতীয়। যিনি সাবেক একজন টেস্ট ক্রিকেটার।

বাঙালি এবং সাবেক টেস্ট ক্রিকেটার শুনে কেউ কেউ হয়তো পশ্চিমবঙ্গের হয়ে রঞ্জি খেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের নেতৃত্ব করা অরুন লাল আর অশোক মালহোত্রার নাম ভাবছেন। তাদের জন্য বলে রাখা ভাল, অরুন লাল আবাহনীর হয়ে সত্তর দশকে বেশ কয়েকবার খেলেছেন। তবে সেটাও সত্তর দশকের শেষ ভাগে।

আর অশোক মালহোত্রা বিচ্ছিন্নভাবে এসে ১-২টি ম্যাচ খেললেও খেলতে পারেন। তবে কখনও নিয়মিতভাবে আবাহনীর পক্ষে খেলেননি। তারা দুজন আশির দশকের পুরো সময় এবং নব্বইয়ে দশকের মাঝামাঝি সময় অবধি ঢাকা লিগে গুলশান ইয়ুথের হয়ে নিয়মিত খেলেছেন। ঢাকা লিগে তাদের দুজনার কয়েক গন্ডা শতক আছে। তবে তারা কেউই আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের প্রথম শতরানকারী নন। সবচেয়ে বড় কথা দুজনার কেউই বাঙালি নন। 

অপরদিকে তখনও পর্যন্ত ঢাকাই ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কান আর পাকিস্তানিদের মেলা বসেনি। পশ্চিমবঙ্গের হাতে গোনা ৫-৭ জন আসতেন তখন ঢাকা লিগ বা ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট খেলতে। সেই তালিকায় আছেন প্রনব রায়, অভিক মিত্র, রাজা ভেঙ্কট, প্রদিপ পান্ডে, পলাশ নন্দী, মিন্টু দাস, সুব্রত চ্যাটার্জি, সাগরময় শেন শর্মা আর পার্থ সেনের নাম। শেষের দুজন পেস বোলার আর বাকি সবাই ব্যাটসম্যান। এ তালিকায় যার নাম সবার ওপরে, সেই প্রনব রায়ই হলেন ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে মোহামেডান-আবাহনী দ্বৈরথে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান।

বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক, লেখক, ইতিহাস, তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণকারি নাজমুল আমিন কিরন সেই সময়ের পত্রিকা আর দলিল ঘেটে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মোহামেডান আর আবাহনী ম্যাচের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হলেন প্রনব রায়। ১৯৮৩-১৯৮৪ মৌসুমে আলফা কাপ নামের এক টুর্নামেন্টে মোহামেডানের হয়ে খেলতে নেমে ঐ শতক উপহার দেন তিনি। 

সেটি ছিল আলফা কাপ টুর্নামেন্টের ফাইনাল। শিরোপা জিতেছিল আবাহনী। ধানমন্ডির দলটির করা ২০৭ রানের জবাবে মোহামেডান ২০০ রানে অলআউট হয়েছিল। একপ্রান্তে প্রনব রায় একাই দিপু রায় চৌধুরী, জালাল ইউনুস, আজম, সামিউর রহমান সামির গড়া আবাহনীর ধারালো বোলিংয়ের বিপক্ষে লড়াই করে মোহামেডানকে নিয়ে যান জয়ের খুব কাছে। যদিও সে ম্যাচে মাত্র ৬ রানের ব্যবধানে হেরে যায় তার দল। 

তবে প্রনব রায় এক নতুন ইতিহাস রচনা করেন। মোহামেডান-আবাহনী মহা দ্বৈরথে প্রথম শতরানকারী ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের নামকে ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখেন। দেশি বিদেশি কত বড় বড় তারকা এ দুই দলের হয়ে খেলেছেন, এ দুই দলের কত আকর্ষনীয়, উপভোগ্য, স্নায়ুক্ষয়ী লড়াই হয়েছে, কতজন সেঞ্চুরি করেছেন। সেই তালিকায় রমন লাম্বা, সামারা সেকেরা, স্টিভ টিকোলো, মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর নাম রয়েছে। তবে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের প্রথম সেঞ্চুরিটি এসেছিল প্রনব রায়ের ব্যাট থেকে।

তরুণ এ ভারতীয় ক্রিকেটার ছিলেন বিশ্ব ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র পঙ্কজ রায়ের ছেলে। যিনি ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ভিনু মানকরের (২৩১) সাথে প্রথম উইকেটে ৪১৩ রান তুলে দীর্ঘদিন টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম উইকেটে সবচেয়ে বড় পার্টনারশিপের  (১৭৩) যৌথ স্রষ্টা ছিলেন।।পরে দুই দক্ষিণ আফ্রিকান নেইল ম্যাকেঞ্জি (২২৬) আর গ্রায়েম স্মিথ (২৩২) ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেই বিশ্বরেকর্ড ভেঙে ৪১৫ রানের নতুন রেকর্ড গড়েন।

সেই পঙ্কজ রায়ের ছেলে প্রনব রায় পশ্চিমবঙ্গের হয়ে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট মানে রঞ্জি ট্রফিতে খেলেছেন টানা ১৩ বছর। প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে প্রনব রায় ১৯৭৮-৭৯ থেকে ১৯৯১-৯২ মৌসুম পর্যন্ত ৭২ ম্যাচে অংশ নিয়ে ১১৪ ইনিংসে করেছেন ৪০৫৬ রান, সর্বোচ্চ ২৩০*, গড় ৪০.৯৬, শতরান ১৩টি ও অর্ধশতক ১১টি।

টেস্ট ক্যারিয়ারটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। মোটে দুটি টেস্ট খেলেছেন। সেটা ১৯৮২ সালে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সেবার কেইথ ফ্লেচারের অধিনায়কত্বে ইংল্যান্ড ভারতে এসেছিল। প্রনব রায় সেই সিরিজে চেন্নাই ও কানপুরে দুটি টেস্ট খেলেন সুনিল গাভাস্কারের নেতৃত্বে ভারতীয় দলের হয়ে। পারফরমেন্স ছিল ভালোয় মন্দে মেশানো।

এআই/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি