ঢাকা, সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪

রাজস্ব আইন সংস্কার প্রয়োজন

প্রকাশিত : ১৩:১৯, ১৩ মার্চ ২০১৯

আইন আজকের নয়, বহুদিনের দাবি। এর যৌক্তিকতা অনেক আগে থেকেই রয়ে গেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে আদি আধুনিক আয়কর আইন (ইন্ডিয়ান ইনকাম ট্যাক্স অ্যাক্ট) প্রবর্তিত হয় ১৯২২ সালে। ১৮৬০ সালে ভারতে ব্রিটিশ শাসন চালুর পর থেকে ব্রিটিশ সরকার আয়করসংক্রান্ত যত সার্কুলার জারি করেছিল, সেগুলোর সমন্বিত রূপই ১৯২২ সালের আয়কর আইন। এ আইনই ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ পর্যন্ত চালু ছিল। ভারত ভাগের পর সামান্য অদল-বদল (যেমন যেখানে ভারত লেখা, সেখানে পাকিস্তান প্রতিস্থাপন) করে চালু রাখা হয়। ভারতীয় প্রজাতন্ত্র ১৯৬১ সালে তাদের জন্য প্রযোজ্য করে পুরনো আয়কর আইন সংস্কার করে। পাকিস্তান সে পথে পা বাড়ায়নি। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ওই একই আইন বলবৎ ছিল। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশেও যেখানে পাকিস্তান লেখা, সেখানে বাংলাদেশ প্রতিস্থাপন হয়ে ১৯৮৪ সাল অবধি ১৯২২ সালের আইনই মূলত কার্যকর থাকে। এরশাদ সরকারের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে আবুল মাল আবদুল মুহিতই প্রথম আয়কর আইন পরিবর্তন হওয়া দরকার বলে মনে করেন। কেননা স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি তখন ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। কাজেই ব্রিটিশ বা পাকিস্তানের আয়কর আইন বদলানো জরুরি সাব্যস্ত করেন তিনি। আয়কর আইন সংস্কার ও সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এটি যখন করা হলো, তখন দেশে সংসদ কার্যকর ছিল না। মূলত আগের আইনের ছায়া অবলম্বনে দেশী-বিদেশী পরামর্শকদের মুসাবিদায় প্রণীত আয়কর আইন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম আয়কর আইন হিসেবে অলোয় আসে। এরপর ১৯৯০ সাল থেকে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার আসায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন থেকেই দাবি অর্ডিন্যান্স নয়, এটিকে আইনে পরিবর্তন করতে হবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে অর্থনীতির স্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে সেটি করতে হবে। সেই থেকে চেষ্টা চলছে, কথাবার্তা চলছে যে আয়কর আইন নতুন করতে হবে। করা হয়নি। এখনো করা যায়নি। এখানে কয়েকটি কারণ রয়েছে। এক. আইনের ওনারশিপ প্রসঙ্গ। অর্থাৎ এটিকে যদি প্রকৃত অর্থে মুক্ত বাজার অর্থনীতির দেশ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশের আয়কর আইন হতে হয়, তাহলে প্রথমে এর ড্রাফট হতে হবে বাংলায়। সংসদ বা আইন পরিষদে এটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হতে হবে। খুব সিরিয়াসলি নিয়ে আইনটির কাঠামো ও দর্শন দাঁড় করাতে হবে। যেহেতু সরকারগুলো পরিবর্তনশীল এবং কর্মকর্তারাও বদলিযোগ্য বা অবসরে যান, সেহেতু তাদের মধ্যে একটি বশংবদ অনীহা বিরাজমান। যারা সংসদে নিয়ে যাবেন এবং সংসদে যারা এটি পাস করবেন, তাদের উভয়ের মধ্যে আন্তরিকতা, প্রতিশ্রুতি ও মেধাবী কর্মোদ্যোগের সম্মিলন না ঘটলে কার্যকর আয়কর আইন হবে না। দেশে কর রাজস্ব সংস্কৃতি উন্নয়নে আইনপ্রণেতাদের অয়োময় আগ্রহ না থাকলে, আইনের খুঁটিনাটি বিচার-বিশ্লেষণের দক্ষতা ও সক্ষমতার সংশ্লেষ না ঘটলে আইন প্রণয়নের, সংশোধন-সংস্কারের কোনো উদ্যোগই গতি পাবে না। আইনপ্রণেতাদের কর পরিশোধের অঙ্গীকার এ আইন যুগোপযোগী করে প্রণয়ন প্রবর্তনের জন্য জরুরি হয়ে দেখা দেয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মেধাবী বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা এবং সরকারের অঙ্গীকার ছাড়া আইনটি সেভাবে কার্যকর হয় না। অথচ এটি অবিলম্বে হওয়া উচিত। একটি আইনের অনেক সংশোধনের বিষয় আছে, ভাষাগত জটিলতা আছে, দ্ব্যর্থবোধকতা আছে, ডেপুটি কমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ডিসক্রিয়েশনারি পাওয়ার-দেয়ার বিষয়সংক্রান্ত নীতিগত বিষয় নির্মোহ দৃষ্টিতে বিবেচনার অবকাশ থেকে যাবে, এগুলো সংস্কারও দরকার। আয়কর আইন একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা দেয়ার মাধ্যমে করদাতাদের হয়রানির সুযোগ সীমিত করার উপায় থাকতে হবে। এ বিষয়গুলো সহজ করা দরকার। করদাতা যেন নিজে নিজেই কর দিতে পারেন। সারা বছর ধরেই কর দেবেন। সুনির্দিষ্ট করে অমুক তারিখের মধ্যে কর দিতে হবে। না দিলে আর্থিক জরিমানা হবে। এসব ব্যবস্থা না থাকলে সুস্থ করের সংস্কৃতি গড়ে উঠবে না। করের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হলে সবাইকে করমনস্ক হতে হবে।

২০০৮ সালে আশ্চর্য হয়েছিলাম, যারা নির্বাচন করবেন, তারা ব্যাপকভাবে বকেয়া পরিশোধ করেছিলেন। তখন মনোনয়নপত্রের সঙ্গে কর সনদ জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। বলা হলো, যাদের টিআইএন নেই, তারা সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হতে পারবেন না। সঙ্গে সঙ্গে তারা টিআইএন খুললেন। পরবর্তীকালে এসব দেখার বা এমনকি সম্পদ বিবরণীর সঙ্গে কর রিটার্নের কাগজপত্র মেলানোর প্রথা পরিপালিত হয়েছিল কিনা, জানা যায়নি। প্রার্থীরা নিয়মিত কর দিয়েছেন কিনা বা তাদের টিআইএন আছে কিনা, তা দেখার প্রয়োজনীয়তা থেমে যাওয়ার নয়। এজন্য যে যারা আইনপ্রণেতা, যারা আয়কর আইনটিকে আইনে পরিণত করবেন, তাদের নিজেদের অবস্থা যদি করদাতা হিসেবে ভিন্ন হয়, তাহলে কী হবে? সর্বশেষ সংসদের ৬২ শতাংশ সংসদ সদস্য হলেন ব্যবসায়ী। তারা নিজেরা যদি কর দেয়ার ব্যাপারে অনীহা পোষণ করেন, তাহলে কীভাবে আয়কর আইন হবে! আয়কর আইনকে প্রকৃত আইনে পরিণত করতে হলে এজন্য অবশ্যই রাজনৈতিক অঙ্গীকার লাগবে।

এদিকে ভ্যাট আইনেরও একই অবস্থা। ২০১২ সালে আইনটি নতুন করে প্রণীত হয়। কয়েক বছর পার হয়ে গেল আইনটি প্রবর্তন করা যায়নি। ২০১৭ সালে আইনটি বাস্তবায়নের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাপে সরকার পিছিয়ে আসে। এবারো এটি বাস্তবায়ন করা হবে কিনা, সংশয় রয়েই যাচ্ছে। ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে না পারার কারণও রাজনৈতিক অঙ্গীকার বা সদিচ্ছার অভাব। এখন বলা হচ্ছে, প্রভাব সমীক্ষা করতে হবে। এটি এতদিন পর কেন করতে হবে। আমার কথা হলো, আইন যেহেতু পাস করা হয়েছে, সেহেতু সেটি পরিবর্তন হয়ে যাবে। এজন্য যার যা অসুবিধা হয়, তা নিরসনে অর্থবিধিতে সংশোধনের সুযোগ থাকবে। নিয়মই আছে। অর্থবিধির মাধ্যমে প্রতি বছর আইনে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান ও সংস্কার করা সম্ভব। এজন্য আইন প্রয়োগ বা প্রবর্তন বারবার পিছিয়ে রাখার কারণ দেখি না। আইন বাস্তবায়ন পিছিয়ে রেখে দুই বছরে সরকার ৪০ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট রাজস্ব আহরণ থেকে বঞ্চিত হলো। জনগণ তো ঠিকই ভ্যাট দিচ্ছে। এখনো আইন প্রবর্তন হয়নি বা ঠিক করা যায়নি। মানুষ ঠিকই কর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটি জমা দেয়া হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, অনলাইন করা হয়নি, কারো মেশিন নেই। এসব তর্ক-বিতর্কে যাওয়ার দরকার নেই। আইন করা হয়েছে, মানে সেটি প্রয়োগ করতে হবে। হ্যাঁ, একটি বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক যৌক্তিক। আমাদের মতো অর্থনীতির জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট সব খাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্যকরণ ঠিক হয় না। গত অর্থবছরে অবশ্য এটি যৌক্তিক করা হয়েছে। চারটি স্তর করা হয়েছে। আরো করা যেতে পারে। এসব নিয়ে আলোচনাও হতে পারে। সারা বছর আলোচনা হোক, অর্থবিধিতে এটি ঠিক করার সুযোগ রয়েছে।

ভ্যাট আইনও স্বতঃপ্রণোদিতভাবে হয়নি। হয়েছে আইএমএফের চাপে। ২০১০ সালে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক সংস্থাটির কাছ থেকে বড় অংকের ঋণ (ইসিএফ) নেয়ার সময় প্রেসক্রিপশন বা শর্ত স্বীকার করে নিয়েছে, তার মধ্যে বড় একটি বিষয় ছিল, ভ্যাট আইন পরিবর্তন। ২০১১ সালে এসে দেখা গেল ঋণের অর্থ ছাড় হয় না। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হলো, ভ্যাট আইন পাস ছাড়া অর্থ ছাড় হবে না। তখন ২০১২ সালে সরকার ভ্যাট আইন পাস করে। বলতে গেলে, আইএমএফের অর্থ ছাড়ের উদ্দেশ্যে ২০১২ সালে ভ্যাট আইন পাস করা হয়। অনুমোদন করা হয়। কিন্তু খেয়াল ছিল না, অনুমোদনের আগে এটা নিয়ে মানুষের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। সামনে নির্বাচন। এ আইন বাস্তবায়ন নিয়ে সৃষ্টি হলো বাড়তি বিপত্তি। এখন সব সমস্যা নিরসন করে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন নিশ্চিত করায় সচেষ্ট হতে হবে সরকারকে। মোদ্দাকথা হলো, রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। শুধু উন্নয়নের স্বার্থে নয়, সুশাসনের স্বার্থেও। নইলে বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে। ধনী অংশ আরো বড় হচ্ছে, দরিদ্রের অংশ কমছে। কর-জিডিপি অনুপাত কম থাকার মানে হলো, কিছু লোক কর দিচ্ছে না, কর না দিয়ে ধনী হচ্ছে, অস্বচ্ছতা সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থ পাচার হচ্ছে। সুতরাং অর্থ পাচার রোধ, অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য দূর করার জন্য রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে।
লেখক : সাবেক সচিব
সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
এসএ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি