শেফিল্ডের অধ্যায় শেষে লেস্টারেও অনিশ্চয়তা, হামজার পরের ঠিকানা কোথায়?
প্রকাশিত : ১৬:০২, ১২ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৬:০৫, ১২ জুন ২০২৫

বাংলাদেশের ফুটবলের নতুন প্রাণভোমরা হামজা চৌধুরী। ইংল্যান্ডে জন্ম হলেও হৃদয়ে ধারণ করেন বাংলাদেশের রঙ। তাঁর পায়ে যেন ফুটবল ফিরেছে ঢাকার মাঠে, আর নতুন আশা জেগেছে দেশের ক্রীড়ামঞ্চে।
কিছুদিন আগেই বাংলাদেশের জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছে হামজার। একই সময়ে প্রবাসী ফাহামিদুল ইসলাম ও শমিত সোমও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন। ঢাকায় সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচে পরাজয়ের মধ্যেও তিনজনের পারফরম্যান্স আলো ছড়িয়েছে।
এবার জাতীয় দায়িত্ব শেষ করে ইংল্যান্ডে ফিরেছেন হামজা। কিন্তু এবার তাঁর ঠিকানা আগের মতো থাকছে না। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ধারে খেলেছেন শেফিল্ড ইউনাইটেডে। তবে ইংল্যান্ডে হামজার ঠিকানা এবার বদলে যাচ্ছে। শেফিল্ড ইউনাইটেডের সঙ্গে ধারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ২৭ বছর বয়সী এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে ফিরতে হচ্ছে মূল ক্লাব লেস্টার সিটিতে। লেস্টারের সঙ্গে তাঁর আরও দুই বছর চুক্তি আছে। তবে লেস্টার সিটিতে ফিরলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি তার।
যদিও গ্রিসের ক্লাব অলিম্পিয়াকোসে নাম লেখানোর সম্ভাবনার কথাও শোনা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত গুঞ্জন সত্যি হলে আগামী মৌসুমে হামজাকে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলতে দেখা যাবে। তবে ক্লাব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তিনি নিশ্চয়ই আর্থিক বিষয়–আশয়ও ভেবে দেখবেন।
শেফিল্ড ইউনাইটেডে থাকতে হামজা কত বেতন পেতেন কিংবা মূল ক্লাব লেস্টার সিটিতে সর্বশেষ তাঁর আয় কত ছিল, এ নিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের কৌতূহল আছে। যদিও ক্লাবগুলো ফুটবলারদের পারিশ্রমিকের অঙ্কটা বরাবরই গোপন রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু নানা মাধ্যম হয়ে শেষ পর্যন্ত অঙ্কটা প্রকাশ পেয়েই যায়।
ফুটবল অর্থনীতি ও বাণিজ্য নিয়ে কাজ করা গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান ক্যাপোলজি যেমন বিশ্বের বিভিন্ন লিগে খেলা ফুটবলারদের সার্বিক তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। ক্যাপোলজির তথ্য অনুযায়ী, শেফিল্ডে থাকতে হামজা সপ্তাহে ৪১ হাজার ৪৭৩ ইউরো (৫৭ লাখ ৮২ হাজার টাকা) বেতন পেতেন। সেই হিসেবে ক্লাব থেকে তাঁর দৈনিক আয় ছিল ৫ হাজার ৯২৪ ইউরো (৮ লাখ ২৬ হাজার টাকা)।
হামজার সঙ্গে শেফিল্ডের ধারের চুক্তি ছিল ২৭ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত। এই ১২৪ দিনে তাঁর পাওয়ার কথা ৭ লাখ ৩৪ হাজার ৫৭৬ ইউরো (১০ কোটি ২৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা)।
ক্যাপোলজি আরও বলছে, ২০২৪-২৫ মৌসুমে হামজাই ছিলেন শেফিল্ডের সর্বোচ্চ বেতনভোগী ফুটবলার। তাঁর সমান বেতন পেয়েছেন চিলিয়ান ফরোয়ার্ড বেন ব্রেরেটন দিয়াজ ও ইংলিশ স্ট্রাইকার রিয়ান ব্রুস্টার।
২৭ জানুয়ারির আগে হামজা খেলেছেন লেস্টার সিটিতে। তবে সেখানে তাঁর সাপ্তাহিক বেতন অনেক কম ছিল ১৭ হাজার ৭৭৪ ইউরো (২৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা)। সেই হিসাবে দৈনিক আয় ছিল ২ হাজার ৫৩৯ ইউরো (৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকা)। এই বেতন শেফিল্ডে পাওয়া বেতনের অর্ধেকেরও কম। আবার লেস্টারে ফেরার পর হামজার বেতন আগের মতোই থাকবে নাকি বাড়বে, তা জানা যাবে ২০২৫-২৬ মৌসুম শুরুর পর।
লেস্টার হামজাকে ধারে শেফিল্ডে পাঠানোর সময় চুক্তিপত্রে একটি বিষয় উল্লেখ ছিল যে, শেফিল্ড চাইলে তাঁকে একেবারে কিনেও নিতে পারবে। তবে বাংলাদেশের তারকা মিডফিল্ডারকে ক্লাবটি এমন কোনো প্রস্তাব দিয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি।
হামজা নিজেও নাকি ক্লাব ফুটবলে ভবিষ্যৎ গন্তব্য নিয়ে দ্বিধায় আছেন। কদিন আগে তাঁর বাবা মোরশেদ দেওয়ান চৌধুরী একটি জাতীয় দৈনিককে জানিয়েছেন, না, এখনো সেটা (শেফিল্ডে থাকবেন নাকি লেস্টারে ফিরে যাবেন) ঠিক হয়নি। আমি নিজেও ওর কাছে জানতে চেয়েছি। সে বলল, “জানি না।” তাই এখনই বলতে পারছি না।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ মৌসুম ১৮তম হয়ে শেষ করায় লেস্টার সিটির অবনমন হয়েছে। ওদিকে শেফিল্ড ইউনাইটেড প্রিমিয়ার লিগে ওঠার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেও শেষ পর্যন্ত পারেনি। চ্যাম্পিয়নশিপের প্লে-অফ ফাইনালে হামজার শেফিল্ড হেরে গেছে সান্ডারল্যান্ডের কাছে। এর ফলে ২০২৫-২৬ মৌসুমে লেস্টার-শেফিল্ড দুই ক্লাবকেই দ্বিতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় খেলতে হবে।
রুড ফন নিস্টলরয় লেস্টারের কোচ হওয়ার পর হামজাকে বলতে গেলে খেলার সুযোগই দেননি। তবে শেফিল্ড কোচ ক্রিস ওয়াইল্ডার তাঁর ওপর আস্থা রেখেছেন। প্রায় প্রতি ম্যাচেই তাঁকে শুরু থেকে খেলিয়েছেন। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেও শেফিল্ডে হামজাকে বেশিরভাগ সময় খেলতে হয়েছে রাইট-ব্যাক হিসেবে। এই পজিশনেও তিনি দারুণভাবে মানিয়ে নিয়েছিলেন।
লেস্টার শহরের স্থানীয় পত্রিকা লেস্টার মার্কারি বলছে, শেফিল্ড প্রিমিয়ার লিগে উঠলে তারা হামজাকে লেস্টারের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিত। কিন্তু হামজা হয়তো টানা দুই মৌসুম ক্লাবটির হয়ে চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে চাইবেন না। এদিকে লেস্টার নাকি তাঁকে বিক্রি করে দিতে চায়।
রেডিও স্পোর্ট এফএমের এক রিপোর্টে জানা গেছে, হামজাকে দলে ভেড়াতে চায় দেশটির সফলতম ক্লাব অলিম্পিয়াকোস। ক্লাবটির বর্তমান কোচ হোসে লুইস মেন্দিলিবারের নাকি হামজার খেলা বেশ মনে ধরেছে। মেন্দিলিবার যে কৌশলে অলিম্পিয়াকোসকে খেলান, তার সঙ্গে হামজা সহজেই মানিয়ে নিতে পারবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
অলিম্পিয়াকোস ২০২৪-২৫ মৌসুমে গ্রিক সুপার লিগ জেতায় সরাসরি চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলবে। এই সুযোগ হামজার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
বর্তমানে হামজার বাজারমূল্য ৪৫ লাখ ইউরো (৬২.৯ কোটি টাকা) বলে জানিয়েছে ট্রান্সফারমার্কেট। লেস্টার যদি তাঁকে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়, এই অঙ্ক হতে পারে আলোচনা শুরু করার ভিত্তি।
শেফিল্ডে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার না হয়ে রাইট ব্যাক হিসেবে খেলেও দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছেন হামজা। কোচ ক্রিস ওয়াইল্ডারের আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দিয়ে। ঠিক এই আত্মবিশ্বাসই হয়তো তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে আরও উঁচু মঞ্চে।
হামজা চৌধুরীর ক্লাব ক্যারিয়ার এখন একটি মোড়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে সিদ্ধান্ত যেদিকেই যাক না কেন, তাঁর প্রতিটি পা ফেলার শব্দ শুনছে বাংলাদেশ। কারণ ফুটবল মাঠে তাঁর উপস্থিতিই এখন অনুপ্রেরণার প্রতীক, উদ্যমের অনুঘটক।
যেখানেই খেলুন না কেন, দেশের পতাকা যেন সঙ্গী হয়ে থাকে। কারণ হামজার মাধ্যমে এখন জেগে উঠেছে এক জাতির ফুটবল ভবিষ্যৎ।
এমবি//