ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল করলেও, নেপাল-ভুটানগামী রপ্তানিতে ছাড়
প্রকাশিত : ২১:১১, ৯ এপ্রিল ২০২৫ | আপডেট: ২১:২০, ৯ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশের পণ্য তৃতীয় দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত। তবে এই সিদ্ধান্ত নেপাল ও ভুটানগামী রপ্তানির ওপর প্রযোজ্য হবে না বলে স্পষ্ট করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারতের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দেশটির বন্দর বা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য অন্য কোনো দেশে পাঠানো আর সম্ভব হবে না। তবে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে নেপাল ও ভুটানে যে পণ্য পরিবহন হয়, সেই ব্যবস্থা বহাল থাকবে।
বিষয়টি ঘিরে ভারত ও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার পর বুধবার সন্ধ্যায় বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বুধবার (৯ এপ্রিল) এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলোতে উল্লেখযোগ্য পণ্যজট সৃষ্টি হচ্ছিল। এই কারণে আমাদের নিজস্ব রপ্তানিতে বিলম্ব, খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যাকলগ তৈরি হচ্ছিল। ফলে, এই সুবিধা ৮ এপ্রিল ২০২৫ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
“স্পষ্ট করে বলা যায়, এই সিদ্ধান্ত ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে নেপাল বা ভুটানে পণ্য পরিবহনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।”
ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডিরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) মঙ্গলবার এক সার্কুলারে বাংলাদেশের পণ্যে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত জানায়।
ওই সার্কুলারে ২০২০ সালের ২৯ জুনের একটি সার্কুলার ‘অবিলম্বে’ বাতিল করার কথা বলা হয়।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্য কনটেইনার বা কভার্ড ভ্যানের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে ভারতের স্থল শুল্ক স্টেশন থেকে দেশটির অন্য কোনো বন্দর বা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল পুরনো ওই সার্কুলারে।
নতুন নির্দেশনায় বলা হয়, বর্তমানে ট্রানজিটে থাকা বাংলাদেশি পণ্য বিদ্যমান প্রক্রিয়ার আওতায় ভারত ছাড়তে পারবে, তবে নতুনভাবে কোনো পণ্যের চালান ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পাবে না।
ওই সার্কুলারের ভিত্তিতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে ভুটান, নেপাল ও মিয়ানমারের মত দেশের সঙ্গে স্থলপথে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাণধীর জয়সওয়াল নয়া দিল্লিতে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, “আমি কিছু প্রতিবেদন দেখেছি, তাই বিষয়টি স্পষ্ট করছি।”
তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিটিও পড়ে শোনান।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী, সদস্য দেশগুলোকে ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর জন্য অবাধ ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়।
১৯৯৪ সালে সংস্থাটির জারি করা জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড (জিএটিটি) এর পঞ্চম অনুচ্ছেদ অনুসারে, সব সদস্যকে স্থলবেষ্টিত দেশগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট দিতে হবে এবং এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সীমা দেওয়া যাবে না। তাছাড়া এই পণ্য পরিবহনকে শুল্কের আওতায় ফেলা যাবে না।
ফলে ভারত যদি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করত, তা ডব্লিউটিওর নিয়মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
আকস্মিকভাবে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের কোনো কারণ সিবিআইসির সার্কুলারে না থাকায় বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা কল্পনা শুরু হয়ে যায়।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার এক বক্তব্য ঘিরে দুই দেশের সাম্প্রতিক উত্তেজনার সঙ্গে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা দেখা যায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে।
২৮ মার্চ বাংলাদেশের বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরতে গিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বেইজিংয়ে চীনা ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, “ভারতের সাত রাজ্য, ভারতের পূর্বাঞ্চলে, যেগুলোকে সেভেন সিস্টার্স বলা হয়ে থাকে… ভারতের ভূবেষ্টিত অঞ্চল। সমুদ্রে যাওয়ার কোনো উপায় তাদের নেই। এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক আমরা।
“ফলে, এটা বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। এটা চীনের অর্থনৈতিক বর্ধিতাংশ হতে পারে। বিভিন্ন জিনিস নির্মাণ, উৎপাদন করুন, বাজারজাত করুন; জিনিসপত্র চীন নিয়ে আসুন কিংবা সারাবিশ্বে পাঠিয়ে দিন।”
তার ওই বক্তব্য ঘিরে রীতিমত হৈ চৈ শুরু হয় ভারতে। বাংলাদেশ-চীনের আলোচনায় ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলোকে টেনে আনায় ইউনূসের সমালোচনামুখর হন ভারতের রাজনীতিক, সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়, ইউনূসের ওই বক্তব্যকে ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে ‘কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের সুবিধাজনক অবস্থান’ তুলে ধরার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছে। নয়াদিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের অবস্থা যখন নাজুক, তখন চীনকে ‘নতুন কৌশলগত অংশীদার; হিসেবে চিত্রিত করাও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরো জটিল করে তুলেছে।
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) সহ-প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ভারত গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশকে ‘একতরফাভাবে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার’ দিয়ে সহায়তা করে এসেছে। তবে বাংলাদেশের লালমনিরহাটে একটি বিমানঘাঁটি চীনের সহায়তায় সচল করার উদ্যোগ ভারতের শিলিগুঁড়ি করিডোরের কাছাকাছি হওয়ায় ভারত এ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে।
লালমনিরহাটের বিমানঘাঁটিটি ভারতের শিলিগুঁড়ি করিডোর বা ‘চিকেনস নেক’-এর খুব কাছে, যা ভারতের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে সংযোগের একমাত্র পথ। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ এই অঞ্চলে ‘কৌশলগত সহযোগিতা’ বৃদ্ধির চেষ্টা করছে এমন প্রতিবেদনে নয়াদিল্লির উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
এমবি//
আরও পড়ুন