ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

এফবিআই’র ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় কে এই ‘ক্রিপ্টোকুইন’?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৫৯, ২ জুলাই ২০২২

রুজা ইগনাতোভের

রুজা ইগনাতোভের

ভুয়া অর্থলগ্নি সংস্থা খুলে বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। বছর তিনেকের মধ্যে কম করে হলেও অন্তত ৪০০ কোটি ডলার! বাংলাদেশি মুদ্রায় যার মূল্য ৩৭ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। কিন্তু কে এই নারী?

২০১৭ সালের অক্টোবরে আচমকাই গায়েব হয়ে যান ‘ক্রিপ্টোকুইন’। তারপর থেকে হন্যে হয়ে খুঁজেও তাকে ধরতে পারেনি ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন- এফবিআই। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাটি।

বৃহস্পতিবার এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড ১০ জন অপরাধীর তালিকায় ঢুকে পড়েছেন এই সুন্দরী। কিন্তু কে এই ‘ক্রিপ্টোকুইন’?

এফবিআইয়ের খাতায় ‘ক্রিপ্টোকুইন’ নামে পরিচিত এই নারীর পোশাকি নাম রুজা ইগনাতোভা। বুলগেরিয়ার পাশাপাশি জার্মানিরও নাগরিক রুজার বিরুদ্ধে কোটি কোটি ডলার ‘লুট’ করার অভিযোগ তুলেছে এফবিআই। তার সম্পর্কে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারলে এক লক্ষ ডলারের পুরস্কারও ঘোষণা করেছে তারা।

এফবিআইয়ের পাশাপাশি ইউরোপীয় গোয়েন্দাদের নজরে রয়েছেন রুজা। মে মাসে তাকে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকাভুক্ত করে ইউরোপোল। সঙ্গে গ্রেফতারিতে সাহায্য হয়- এমন তথ্য দিতে পারলে চার লক্ষ ডলারেরও বেশি পুরস্কারমূল্য ঘোষণা করে। তবে ইউরোপ হোক বা আমেরিকা, কোনো দেশের গোয়েন্দারাই রুজাকে পাকড়াও করতে পারেননি।

৪২ বছর বয়সী এই নারীর জন্ম বুলগেরিয়ার সোফিয়ায়। তবে ১০ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে জার্মানির স্রামবার্গ শহরে চলে যান তিনি। সেখানেই বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সবকিছু।

গোয়েন্দাদের দাবি, আর পাঁচটা ঝানু অপরাধীর মতো নন রুজা। বরং তিনি উচ্চশিক্ষিত। আইনের মারপ্যাঁচ সম্পর্কেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।

মার্কিন গোয়েন্দাদের দাবি, ২০০৫ সালে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট ইন্টারন্যাশনাল ল’ নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন রুজা। যদিও অনেকের দাবি, অক্সফোর্ড থেকে পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছে তার। উচ্চশিক্ষা শেষে ম্যাকিনসে-র মতো বহুজাতিক সংস্থায় নাকি চাকরিও করেছেন।

এক কালে উরসুলায় একটি সালোঁতে বিনিয়োগও করেছিলেন রুজা। সেটা ছিল ২০১১ সালে নভেম্বর। তবে, রুজার অপরাধের কাহিনী প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০১২ সালে। সঙ্গে ছিলেন তার বাবা প্লামেন ইগনাতোভও। সে বছর জার্মানির একটি সংস্থার অধিগ্রহণের মামলায় প্রতারণার অভিযোগে দু’জনকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ওই মামলায় ১৪ মাসের কারাদণ্ড হয়েছিল রুজার।

জেলে থাকাকালীনই সম্ভবত অপরাধ জগতের সঙ্গে গভীরভাবে সখ্য করে ফেলেছিলেন রুজা। ২০১৩ সালে বিগকয়েন নামে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সির মার্কেটিং সংক্রান্ত প্রতারণায় জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

এফবিআইয়ের দাবি, ২০১৪ সাল থেকে গণমাধ্যমে লোকঠকানোর ব্যবসাও জি স্কিমের কারবারে ঢুকে ঢুকে পড়েন রুজা। সে বছরের অক্টোবরে ওয়ানকয়েন নামে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসা শুরু করেন বলে অভিযোগ। গোয়েন্দাদের দাবি, বিশ্বজুড়ে ওই কারবারের জাল ছড়াতে ইউটিউব-সহ একাধিক নেটমাধ্যমের সাহায্য নিয়েছিলেন রুজা।

সংবাদমাধ্যমে আমেরিকার গোয়েন্দাদের দাবি, ২০১৪ সালে ওয়ানকয়েনে বিনিয়োগ করলে প্রচুর মুনাফা হবে বলেও চাউর করতে থাকেন রুজা। বিনিয়োগকারীরা যত লোককে এই ক্রিপ্টোকারেন্সি সংস্থায় টেনে আনতে পারবেন, তাদের তত লাভ হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।

স্মার্ট, ঝকঝকে চেহারার উচ্চশিক্ষিত রুজার কথায় অনেকেই নাকি ওয়ানকয়েনে বিপুল বিনিয়োগ করেন। এমনই জানিয়েছেন এফবিআইয়ের গোয়েন্দারা। 

যদিও এফবিআইয়ের মতে, ওয়ানকয়েন নামের ক্রিপ্টোকারেন্সির (ইন্টারনেটের মাধ্যমে লেনদেনের ডিজিটাল মুদ্রা) আসলে শেয়ারবাজারে কোনো মূল্যই ছিল না। এমনকি, ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্লকচেন নামে যে আন্তর্জাল ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ হয় এবং যার মাধ্যমে গেলে বিনিয়োগ সুরক্ষিত থাকে, সেই সুরক্ষাও ছিল না ওয়ানকয়েনের।

গোয়েন্দাদের দাবি, ওয়ানকয়েন আসলে ক্রিপ্টোকারেন্সির ছদ্মবেশে থাকা একটি পন্‌জি স্কিম। যার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা লুটেছেন রুজা।

ডেমিয়ান উইলিয়ামস নামে ম্যানহাটনের এক আইনজীবীর দাবি, ‘মোক্ষম সময়ে এই ভুয়া সংস্থা খুলেছিলেন রুজা। যে সময় ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে মাতামাতি তুঙ্গে, তখনই তিনি এই কারবার ফেঁদে বসেন।’

বছর দুয়েকের মধ্যে বিপুল মুনাফা করেছিল ওয়ানকয়েন। ২০১৪ সালের অর্থবর্ষের চতুর্থ ত্রৈমাসিক থেকে ২০১৬ সালে তৃতীয় ত্রৈমাসিকের মধ্যে ওয়ানকয়েন ৩৭৮ কোটি ডলারের মুনাফা করেছিল বলে দাবি এফবিআইয়ের আইনজীবীদের।

শেয়ারবাজারে মূল্যহীন হলেও মাল্টিলেভেল মার্কেটিং পদ্ধতিতে বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে রুজার ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছিল। এফবিআইয়ের দাবি, বিশ্বজুড়ে ৩০ লক্ষ বিনিয়োগকারীকে শুধুমাত্র মোটা অঙ্কের কমিশনের লোভ দেখিয়ে নিজের ভুয়া সংস্থায় টেনে এনেছিলেন রুজা।

২০১৯ সালে আর্থিক প্রতারণা মামলায় নাম জড়িয়েছিল রুজার ভাই কনস্ট্যানটিন ইগনাতোভের। সে সময় আমেরিকার লস এঞ্জেলেসে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ওই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন রুজার ভাই কনস্ট্যানটিন।

এফবিআইয়ের দাবি, অপরাধের নিরিখে বাবা এবং ভাইকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন রুজা। ২০১৭ সালে বুলগেরিয়ার সোফিয়া থেকে গ্রিসে যাওয়ার বিমানে উঠেছিলেন তিনি। সে সময় তার সঙ্গে যে পরিমাণ অর্থ ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় তার মূল্য প্রায় পাঁচ কোটি ৯২ লাখ টাকা। তারপর থেকে সেই যে গা-ঢাকা দিয়েছেন রুজা, আজ পর্যন্ত তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।

বিশ্বজুড়ে রুজার নাম ছড়িয়ে পড়ে ২০১৯ সালে। সে বছর বিবিসি-র তদন্তমূলক পডকাস্টে জায়গা করে নেন তিনি। ‘মিসিং ক্রিপ্টোকুইন’ নামে ওই পডকাস্টটির সাংবাদিক জেমি বার্টলেট দীর্ঘ দিন ধরে রুজার বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। 

জেমির দাবি, ‘প্রচুর ভুয়া পরিচয়পত্র নিয়ে পালিয়েছেন রুজা। আমাদের বিশ্বাস, এত দিনে হয়তো নিজের চেহারাও পাল্টে ফেলেছেন।’ 

এমনকি, রুজা সম্ভবত আর বেঁচে নেই বলেও দাবি করেন বিবিসি এই পডকাস্ট সাংবাদিক।

এনএস//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি