চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর কি ব্যর্থ?
প্রকাশিত : ১১:৪২, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ | আপডেট: ১১:৫৭, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

২০১৫ সালের এপ্রিলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) নামে একটি দ্বিপাক্ষিক প্রকল্পে স্বাক্ষর করেন।
প্রেসিডেন্ট জিনপিং একে ‘দ্য প্রজেক্ট অব দ্য সেঞ্চুরি’ বলে অভিহিত করেন। তিনি নওয়াজ শরীফকে বলেন এ প্রকল্প শিল্প, অবকাঠামো, পরিবহন ব্যবস্থা এবং জ্বালানি উৎপাদন খাতের আধুনিকায়নের মাধ্যমে পাকিস্তানকে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের এক অভূতপূর্ব যুগে নিয়ে যাবে।
পাশাপাশি, পাকিস্তান তার গোয়াদর এবং করাচীর গভীর সমুদ্র বন্দরের বিকাশ সাধন করে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের সাথে এবং প্রদেশের বাইরে তার ওভারল্যান্ড রুটের সাথে সংযুক্ত করে লাভবানও হয়।
চীনের জন্য সিপিইসি শি জিনপিংয়ের ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা চীনের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নীতির মেরুদণ্ড গঠন করে। কারণ চীন সিপিইসির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরেশিয়ার বিশাল বাজারের দিকে নজর রাখতে পারে।
মূলত ৪৬ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প এখন ৭০ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে এবং এই একটি প্রকল্প দুই দেশের মধ্যে বিতর্কেরও সৃষ্টি করেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে ২৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ইতিমধ্যেই ধূলিস্যাৎ হয়েছে, সিপিইসি কোনো কাজেই আসছে না বরং এটি ঋণের পাহাড়ে পরিণত হয়েছে এবং উভয় দেশের জন্যই একটি অস্থিতিশীল প্রকল্পে পরিণত হয়েছে।
বিশেষ করে বেলুচিস্তান এবং গিলগিট-বালতিস্তানে এই প্রকল্পটি আর্থিক চাপ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং নাগরিক অস্থিরতার সম্মুখীন হয়েছে বলে চীন পাকিস্তানের কঠোর সমালোচনা করেছে। তদুপরি, এই প্রকল্পে কাজ করা চীনা নাগরিকদের রক্ষা করতে পাকিস্তান ব্যর্থ হয়েছে। এই ঘটনায় চীন ক্রমাগতই হতাশার দিকে যাচ্ছে, কারণ তাদের উপর হামলা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
২০২২ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে চীনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মাত্র ০.৪ শতাংশে নেমে আসায় বিআরআইর অধীনে নতুন বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা এই বছরের ৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এটি চীনকে বিআরআই প্রকল্প এবং তার অর্থায়ন পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে।
অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তারা চীনা ঋণদাতাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তান তার ঋণ পরিশোধের পুনর্গঠনের দিকে ভরসা করে বসে আছে এবং চীনা ঋণদাতাদের সাথে উচ্চ-সুদের হার নিয়ে পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে, এবং এই কারণে ঋণ খেলাপিরাও শেষ পর্যন্ত চীনের আর্থিক স্থিতিশীলতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এটি উভয় দেশের জন্যই শুভ নয়, কারণ সিপিইসির অর্থনৈতিক টেকসই মডেল অস্থিতিশীল হওয়ার জন্য চীন ৫৬ শতাংশ টাকা কমাতে বাধ্য হয়েছে। সিপিইসি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়োজিত চীনা শ্রমিকদের অর্থ প্রদানের জন্য পাকিস্তানের তহবিলের অভাব রয়েছে। এমনকি সিপিইসির নেতৃত্বাধীন বিদ্যুৎ প্রকল্পের কয়লা কেনার জন্য তাদের কাছে প্রয়োজনীয় তহবিলও নেই।
চীনা বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর কাছে এর বকেয়া ঋণের পরিমাণ ৩০০ বিলিয়ন পিকেআর, যার ফলে চীনা কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোকে বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলস্বরূপ, সিপিইসি বিদ্যুৎ প্রকল্পের ৩৭ শতাংশ ধারণ ক্ষমতা, যা প্রায় ১৯৮০ মেগাওয়াট, ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে পাকিস্তান শক্তি সঙ্কটের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে।
পাকিস্তানে চীনের সহায়তা, বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহযোগিতার মাত্রা আইএমএফ এর সহায়তার চেয়েও তিনগুণ বেশি। আইএমএফ এর রিপোর্ট অনুযায়ী পাকিস্তানের চীনের কাছে ৩০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ রয়েছে যা তার মোট বহির্গামী ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ।
তাছাড়া, পাকিস্তান সিপিইসি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীন থেকে সরঞ্জাম কিনতে বাধ্য হয়েছিল। যার ফলে তার ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যায়। ৪ শতাংশ থেকে ৬.৫ শতাংশের মধ্যে উচ্চ সুদের হারসহ বিলিয়ন ডলারের স্বল্পমেয়াদী ঋণ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্দশাকে আরো জটিল করে তোলে।
যদিও পাকিস্তান সম্প্রতি ১.২ বিলিয়ন ডলারের আরেকটি আইএমএফ বেলআউট নিয়েছে, যার লক্ষ্য তার ডুবন্ত অর্থনীতিকে কিছুটা সচল রাখা। কিন্তু এটি মূলত চীনের ঋণ ফাঁদ কূটনীতি, এবং পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত অতলে ডুবে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক বন্যা এ অর্থনীতিকে আরো ধ্বংস করেছে এবং বন্যার ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলার। বন্যার কারণে চলমান সিপিইসি প্রকল্পের বেশিরভাগ অবকাঠামোর ক্ষতি এর পুনর্নির্মাণের ব্যয়কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আশ্চর্যের বিষয় হল, বেলুচিস্তান প্রদেশের অধীনস্থ গোয়াদার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। কিন্তু এটি প্রকল্পের একটিও সুফল আজ পর্যন্ত দেখেনি। এমনকি এটি পানীয় জল এবং বিদ্যুতের মতো মৌলিক সুবিধাগুলো ছাড়াই রয়েছে।
স্থানীয়দের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভেস্তে গেছে। কারণ চীনা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি চীনা পরিবারের থাকার জন্য বিশাল টাউনশিপ তৈরি করেছে। স্থানীয় বেলুচ জনগণ এজন্য যথেষ্ট বিরক্ত। তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের জমি অবৈধভাবে চীনাদের কাছে হস্তান্তর করার এবং জনসংখ্যার পরিবর্তন শুরু করার অভিযোগ তুলেছে।
এটি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে বেলুচরা নিজেদের আদিবাসী বলে দাবি করে এবং বেলুচিস্তানের অবৈধ দখলের জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) পাকিস্তানে চীনা নাগরিকদের উপর আক্রমণ করায় এটি চীনাদের জন্য আরও নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করেছে।
রিপোর্ট মোতাবেক চীন গোয়াদরকে পিএলএ-র নৌবাহিনীর জন্য একটি অগ্রবর্তী নৌ ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলছে যাতে ভারত মহাসাগরে তার কার্যক্রম আরও জোরদার করা যায়। কারণ গোয়াদরে এখনো কোনো বাণিজ্যিক বন্দরের কার্যক্রম হয়নি।
কিন্তু গিলগিট-বালতিস্তানের মানুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সিপিইসি প্রকল্পের আড়ালে বড় আকারের জমি দখলের অভিযোগ তুলেছে। তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগামী পাঁচ দশকের মধ্যে এই অঞ্চলটি চীনাদের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ করেছে এবং এইভাবেই তাদের সার্বভৌম অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে দাবি করেছে।
সিপিইসি পাকিস্তানি দরিদ্রদের জন্য লক্ষ লক্ষ চাকরির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল, কিন্তু আট বছর পরে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের দরিদ্ররা এখনও বেকার, অপরদিকে হাজার হাজার চীনারা সিপিইসি প্রকল্পগুলিতে চাকরি খুঁজে পেয়েছে। এটি পাকিস্তানি জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তারা চীনাদের বিরুদ্ধে তাদের চাকরি কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ করেছে।
যেহেতু অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলি চীনের অশুভ বিআরআই প্রকল্প পরিকল্পনার ঋণের ফাঁদে কূটনীতিতে পড়েছে, এর মাঝেপাকিস্তানই চরম অস্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই অঞ্চলে তার ভূ-রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার কারণে, চীনাদের সাথে যেকোনো অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বকেই মূল্য দিতে হবে।
যদিও সিপিইসির জন্য বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ পাওয়ার চেষ্টা চীন এবং পাকিস্তান উভয় পক্ষ থেকেই করা হয়েছে। তবে এতে সাড়া পাওয়া যায়নি। সৌদি আরব, কাতার, তুরস্ক, কিরগিজস্তান এবং রাশিয়া সকলেই আপাতত সিপিইসি-তে যেকোন বিনিয়োগ করার বিষয়ে স্পষ্ট না জানিয়ে দিয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতেও বিনিয়োগের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
পাকিস্তান ও চীন উভয়ের জন্য আসন্ন এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের প্রাধান্য হবে সিপিইসি বিনিয়োগের জন্য কিছু অংশীদারকে আকৃষ্ট করা, কিন্তু ঋণ-ফাঁদে আটকে থাকা চীনা নীতির কারণে এটি বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
চীন ও পাকিস্তান উভয়কেই সিপিইসি থেকে তাদের প্রত্যাশা কমাতে হবে। চীনের অতি উচ্চাভিলাষী বিআরআই প্রকল্পের অসারতা উপলব্ধি করাটা অপরিহার্য, যা সার্বভৌমত্বের সাথে আপস করার অভিপ্রায়ে দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিকে আকর্ষণীয় অর্থনৈতিক ঋণ প্রদানের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
এই ধরনের উচ্চাভিলাষী মডেলগুলো ব্যর্থ হতে বাধ্য কারণ এগুলো দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিবর্তে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। সিপিইসি প্রতিশ্রুত সুবিধা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পাকিস্তান উভয়েরই দ্বারপ্রান্তে।
# ফ্রিল্যান্সার রাজা মুনিবের কলাম থেকে ভাষান্তার।
আরএমএ
আরও পড়ুন